ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ, অতঃপর

সুলতানা রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪
ব্যাড নিউজ ইজ গুড নিউজ, অতঃপর

সুন্দরবন থেকে ফিরে: সাংবাদিকতায় ‘Bad news is good news’। সুন্দরবনে তেলের জাহাজ ডুবি এবং পরে পরিবেশ বিপর্যয় সংক্রান্ত খবর সাংবাদিকতায় গুড নিউজ বা বড় ঘটনা।

এই তত্ত্ব অনুযায়ী সুন্দরবন ঘুরে রিপোর্টার হিসেবে আমি হতাশ। কারণ- তিনটি কাঁকড়া, একটা ছাগল, একটা গরু, একটা মুরগী ছাড়া মৃত কোনো প্রাণী দেখিনি। কাঁকড়া ফার্নেস তেলের কারণে মারা যেতে পারে, কিন্তু নদীর পানিতে ভেসে আসা গরু-ছাগল-মুরগীর মৃদদেহ অস্বাভাবিক বা তেলের কারণে মরেছে এমনটি বলা মুশকিল।
 
তেলের কারণে ‘Animal starts to die’ শিরোনামে প্রথম সাড়ির ইংরেজি দৈনিকের খবর দেখে ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম, তেলবাহী জাহাজ ডুবি দুর্ঘটনার তিন দিন পর। প্রথম দিন দেখলাম পশুর নদীর তীরে একটা মেটে সাপ কাদায় গড়াগড়ি করছে, কোথাও তেলের চিহ্ন নেই। স্থানীয় সাংবাদিক ও বাসিন্দাদের জিজ্ঞেস করলাম- তেল কোথায়? পশুর নদীতে তো কিছু দেখছি না!
 
সবাই বললো- প্রথম দিন পশুর নদীতেও তেল ছিলো, জোয়ারের পানিতে চলে গেছে। তবে জয়মনিগোলে শ্যালা নদীতে এখনও অনেক তেল। খুব খারাপ অবস্থা। ওইখানে যান।
 
এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রওয়ানা হলাম জয়মনির গোল, সময় বাঁচাতে ক্যামেরাম্যান এবং আমি রওয়ানা হলাম মোটরবাইকে, আর লাইভ ইউনিট পাঠালাম নৌপথে, বোটে।
 
শ্যালা নদীর এক মাথায় পশুর নদী, অন্য মাথায় বলেশ্বর নদী। ভাটা শেষ হওয়ার আগেই শ্যালায় জোয়ার শুরু হয়। ফলে শ্যালা নদীর পানি কিছুটা স্থিতিশীল।
মূলত এ কারণেই এই নদী ডলফিনের অভয়ারণ্য। তেলবাহী জাহাজ ডুবির পর থেকে সেখানে ডলফিনের দেখা মিলছে না, এমনকি একটি ডলফিনের মরে ভেসে ওঠার কথাও শুনলাম। পশুর নদীর পাড় থেকে মোটরসাইকেলে আধা ঘন্টার পথ পারি দিয়ে পৌঁছলাম শ্যালা নদীর তীর জয়মনির গোলে।

সেখানে পৌঁছে আমার রিপোর্টার মন আবার হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো, সুন্দরবনের নদী খালের পানি পলি মাটির কারণে সব সময়ই ঘোলা থাকে, সেই ঘোলা পানিতে তেলের হালকা আবরণ আছে বটে তবে খালি চোখে খুব বিপজ্জনক কিছু মনে হলো না। বরং নদীর দুই কূল মনে হলো কেউ কালো কালি মাখিয়ে রেখেছে, নদী খাল সংলগ্ন গাছের শিকড়, ম্যানগ্রোভ কালো হয়ে গেছে। ভাটার সময় নদীর যে চর বা তীরভূমি জেগে ওঠে সেখানে তেলের আস্তর পৌষের রোদে মাঝেমাঝে চিকচিক করে উঠছে।

মাঝ নদীতে হঠাৎ দুটো ডলফিনকে দেখলাম মাথা তুলে তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আমার চোখ চকচক করে উঠলো, খুশিতে আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম। স্থানীয়রা বললো গত তিনদিন তাদের দেখা যায়নি। এরইমধ্যে সহকর্মী অনির্বাণ শাহরিয়ার জানালো, একটি ডলফিনের মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে, সে সেখানে যাচ্ছে। আমি যোগাযোগ করলাম, বিদেশি ডলফিনপ্রেমী স্মিথের সঙ্গে। জানালো, দুর্ঘটনার পর থেকেই সে ডলফিনের খোঁজ রাখছে, এখন পর্যন্ত যে কটি ডলফিন তিনি দেখেছেন তাদের কারো গায়ে তেল দেখেননি এবং যে ডলফিন মারা গেছে তা সম্ভবত দুর্ঘটনার দুদিন আগে জেলেদের জালে আটকা পড়ে মরেছে। ডলফিনটির গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিলো বলেও তার ধারনা।
 
সাড়ে তিন লাখ লিটার ঘন কালো আলকাতরার মতো ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের শ্যালা নদীর ঘোলা পানিকে দূষিত করলো অথচ বাহ্যিক দৃষ্টিতে তার বড় ধরনের তেমন প্রভাব দেখছি না, বারবার হোচট খাচ্ছি, হতাশায় ভুগছি। ভেবেছিলাম দেখবো নদীতে মরা মাছ ভাসছে, তেলে ডুবে সুন্দরবনের প্রাণীরা হাঁসফাঁস করতে করতে করতে মরে যাচ্ছে! এমন কিছু না পেয়ে পারসেপশনের সঙ্গে বাস্তবতা মেলাতে পারছি না। চিন্তায় পড়ে গেলাম, সবার মতো ‘ভয়াবহ বিপর্যয়’ বলতে না পারলে তো অনেকে ‘দালালির গন্ধ’ পাবে।

স্থানীয় বাসিন্দা, সাংবাদিক এবং ঢাকা থেকে আগত রিপোর্টারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলাম। সবাই বললো-জয়মনির গোলে খুব খারাপ অবস্থা, বললাম-আমি তো সেখানেই আছি। পাল্টা বললো-জয়মনির গোল পেরিয়ে মৃগামারি এবং আন্ধারমানিকের দিকে সব তেল নেমে গেছে, ওইদিকেই এখন খারাপ অবস্থা, ছোট ছোট খাল দিয়ে তেল ঢুকে পড়েছে বনের আরো গভীরে।

সেদিন সন্ধ্যা নেমে আসায় পরিকল্পনা করলাম পরের দিন ভোরে রওয়ানা হবো মৃগামারি এবং আন্ধার মানিকের উদ্দেশে। পরের দিন জয়মনির গোলে লক্ষ্য করলাম-নদীর চরে গর্ত করে থাকার কথা ছোট ছোট লাল কাকড়া এবং মেনি মাছ। তাদের একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। কথা বললাম বন বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন অফিসারের সঙ্গে। জানালেন, মাটির ওপর তেলের আস্তর জমায় তারা মাটির নিচে চাপা পড়তে পারে। পুরো বিষয়টি বুঝতে ৩/৪ সপ্তাহ সময় লাগবে। আমি আমার রিপোর্টে এই বিষয়টিই ফোকাস করলাম।

একটা জাহাজে লাইভ ব্রডকাস্ট ইকুইপমেন্ট সেট করে রওয়ানা হলাম মৃগামারির উদ্দেশে, সেখানে সুন্দরবনের আরও গভীরে স্থলপথে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জাহাজের সঙ্গে বেঁধে নিলাম ছোট্ট ডিঙ্গি নোকা যাতে ছোট ছোট খালে ঢুকতে পারি। সঙ্গী হলো চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের বিশেষ প্রতিনিধি শাহেদ আলম। মৃগামারি পৌঁছে বাদামতলীর খালে জাহাজ নোঙ্গর করে ফ্লাইওয়ে (লাইভ ইকুইপমেন্ট) সেট করা হলো। শাহেদ আর আমি ক্যামেরা ইউনিটসহ ডিঙ্গি নৌকায় রওয়ানা হলাম খালের ভেতর। দেখলাম একটা ডোরা সাপ গাছে লেপ্টে আছে। সাপটির ছবি নিলাম।
শাহেদ বন বিভাগের সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞেস করল, সাপটার গায়ে যে ছোপ ছোপ কালো দাগ দেখা যাচ্ছে ওগুলো কি তেলের দাগ?
সিকিউরিটি: না, এটা ডোরা সাপ, ওদের গায়ে ফোট ফোট দাগ থাকে।
শাহেদ: দাগগুলো তেল তেল লাগছে না?

গার্ড মনোযোগ দিয়ে দেখে বললো, এই সাপের গায়ে এমন দাগ থাকে।
শাহেদ: শাপটাকে একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছে?
গার্ড: শীতকাল তো গাছে রেস্ট নিচ্ছে মনে হয়।
শাহেদ: একটু দুর্বল লাগছে তো, কিছু খায়নি মনে হয়, না?
গার্ড: খাবারের সংকট হইতে পারে, দুর্বলও হতে পারে, রেস্টও নিতে পারে...

এরইমধ্যে মনুষ্য প্রজাতির অস্তিত্ব টের পেয়ে সাপটি সবল লাফে ধপাস করে পানির নিচে আড়াল হয়ে গেলো।

আমি হেসে বললাম, দুর্বল সাপটি সবলে লাফ দিলো কেমনেরে ‘সর্প বিশেষজ্ঞ’? শাহেদ আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিলো।

দেখলাম জেলেরা কাঁকড়া ধরছে, মাছ ধরছে। এরইমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরা প্যাকআপ করে তীরে রওয়ানা দিলাম।

পরের দিন সকালে দেখা হলো ডেইলি স্টারের রিপোর্টার পিনাকী রায় এবং সমকালের রিপোর্টার রাজিব নূর; দুই সুহৃদ সহকর্মীর সঙ্গে। বললাম, দাদা কাহিনী কী বলেন তো, কোথায় কী পেলেন? আমি তো মেনি মাছ আর লাল কাঁকড়া ছাড়া নিউজ করার তেমন কিছু পাচ্ছি না!

পিনাকী রায় চুপ আর রাজীব নূর বললেন, সুন্দরী গাছের বীজ ভেসে যাচ্ছে, তেল লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। বললাম, সুন্দরী গাছের ফল থেকে বীজ এই মৌসুমে হয় না। কারণ এখন নদীতে মিঠা পানি, সুন্দরী ফল থেকে বীজ হতে লাগে নোনা পানি এবং মিঠা পানির মিশ্রণ, যা কেবল বর্ষা মৌসুমে হয়।

রাজীব দা বললেন, স্থানীয়রা তো স্ট্রংলি বলছেন বীজ সব নষ্ট হয়ে গেছে। আমি বললাম, স্থানীয়রা বলতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত বিষয় তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রাজীব নূর বললেন, হুম বিষয়টা তাহলে আরেকটু দেখতে হবে।

সাড়ে তিন লাখ লিটার তেলের মধ্যে স্থানীয়দের সহযোগিতায় পদ্মা অয়েল সংগ্রহ করতে পেরেছে মাত্র প্রায় চল্লিশ হাজার লিটার। মানে এখনো তিন লাখ লিটার তেল মিশে আছে নদী, খালের পানিতে, গাছের শিকড় শ্বাসমূলে। প্রায় ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার সুন্দরবনের সর্বোচ্চ একশ কিলোমিটারে ছড়িয়েছে তেল। দুর্ঘটনার সময় নদীতে মরা কটাল থাকায় জোয়ারের উচ্চতা ছিল কম। ফলে ফরেস্ট ফ্লোরে তেল প্রবেশ করতে পারেনি, কেবল তীরভূমিতে লেগেছে।

কিন্তু এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ভরা কটাল, এতে বাড়বে জোয়ারের উচ্চতা, পানিতে ডুবে যাবে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা। আর এটিই হচ্ছে আশঙ্কার কথা। এখন যে তেল কূলেকূলে লেগে আছে তা ছড়াবে গভীর থেকে গভীরে। এরইমধ্যে দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের ৭০/৮০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রাণীদের খাদ্যচক্রে কিছুটা প্রভাব হয়তো পড়েছে যা ঠিক হতে কয়েক মাস সময় লাগবে।

এই দুর্ঘটনার ফলে যতটা বিপর্যয় আশংকা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি বটে কিন্তু এতে খুশি হওয়ার কিছু দেখি না। আমার বিবেচনায় এই দুর্ঘটনায় একটা ‘ওয়েক আপ কল’ বা সতর্ক সঙ্কেত। বাংলাদেশের সম্পদ বলতে যেকোনো বিবেচনায় সুন্দরবন এক নম্বর সম্পদ। অথচ তা রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীনতা অকল্পনীয় মাত্রায়। দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে কোনো গাইড লাইন নেই। এমনকি দুর্যোগ যেন না হতে পারে তেমন সতর্কতামূলক প্রস্তুতি অনুপস্থিত। মনে হতে পারে স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদে এখনো টিকে আছে আমাদের সুন্দরবন।
 
এসব ভাবতে ভাবতে ঢাকায় ফিরে এলাম। এ ক’দিন পত্রিকা দেখতে পারিনি বলে সুন্দরবন নিয়ে কে কি করছে সেই খবরও রাখতে পারিনি। বাসায় ফিরে দেখি টেবিলের ওপর রাখা একটা বাংলা দৈনিকের বড় বড় শিরোনামে ‘বিপর্যস্ত পরিবেশ বিপন্ন প্রাণী’ সংবাদ, পাশে একটি কুমিরের ছবি, সাথে ক্যাপশনে লেখা, ‘রোববার আন্ধারিয়ার বাকে এভাবেই পড়ে ছিলো নির্জীব কুমিরটি’। মনে মনে ভাবলাম, পারসেপশন থেকে বেড়িয়ে বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিং খুব সহজ নয়!

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।