সম্প্রতি স্বনামখ্যাত সাংবাদিক কাজী সিরাজ বেসরকারি এক টেলিভিশনের এক টক শোতে বলেছেন, বিএনপি চালাচ্ছে অফিস স্টাফরা। অফিস স্টাফ বলতে এখানে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বেতনভুক্ত স্টাফরা।
তারেক রহমানের মালিকানায় প্রকাশিত দৈনিক দিনকালের একসময়ের সম্পাদক। বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মাঝে একসময় তার ব্যাপক নাম ছিল। তিনি মান্নান ভুঁইয়াপন্থি বলে পরিচিত ছিলেন। মান্নান ভুঁইয়াকে বিএনপি থেকে অপসারণের পর কাজী সিরাজ বেকায়দায় পড়েন। এরপর বিএনপিতে দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক রুহুল আমিন গাজী, শওকত মাহমুদরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেন। কাজী সিরাজ বিএনপি থেকে কিঞ্চিত ছিটকে পড়ার পর কালে ভদ্রে দু’একটি অতি সত্য কথা বলেন।
বিএনপিতে এখন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা বড় হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করতে গেলে তার কয়েক মিনিট আগেই ওই কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা, বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস দেখা করা সম্ভব নয় বলে মাইকে ঘোষণা দেন। এর মিনিট দুয়েক পর শেখ হাসিনা সেখানে পৌঁছুলে গেট তালা বন্ধ করে দেয়া হয়। পুরো ব্যাপারটি বিএনপির স্থায়ী কমিটির অগোচরে হয়, এমনকি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেও পরামর্শ করা হয়নি। পরদিন বিএনপির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ মওদূদ আহমদ সাংবাদিকদের একথা বলেছেনও। তিনি খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কথাও বলেছেন। বলেছেন- সিনিয়র নেতাদের মতামতের বাইরে গুলশান কার্যালয়ের মূল গেট তালাবন্ধ ছিল।
স্বাভাবিকভাবেই ঐদিন সদ্য সন্তান হারানো খালেদা জিয়া মানসিকভাবে স্থির এবং দৃঢ় ছিলেন না। থাকার কথাও নয়। এই সুযোগে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের কর্মকর্তারাই যেন খালেদা জিয়া হয়ে উঠলেন। তারা ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত দিলেন। এমন কিছু লোক সবসময়ই সব জায়গায় থাকে তারা নিজেকে বড় কিছু ভাবতে শুরু করেন। নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজেকে জাহির করেন।
কিছুদিন আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হওয়ার আগে প্রেসক্লাবে অবস্থান করছিলেন। তাকে গ্রেফতার করার আগমুহূর্তে বিএনপিপন্থি সাংবাদিকরা তাকে পরামর্শ/উপদেশ দিতে দিচ্ছিলেন- গ্রেফতার হওয়ার আগে জ্বালাময়ী বিবৃত দেয়ার জন্য। কী বলতে হবে তাও শিখিয়ে দিচ্ছিলেন তারা। ওনারা চাচ্ছিলেন ওনারাই ফখরুল সাহেবকে পরিচালিত করুক। ফখরুল সাহেব রাজনীতি করেন, তিনি জানেন কখন কী বলা দরকার। যাই হোক তিনি তখন বিবৃতি দেন নি।
১৯৭১ সালে ৭ মার্চের আগেও এমন ঘটনা ঘটত। ছাত্রনেতারা গ্রুপে গ্রুপে শেখ মুজিবের বাসায় ঢুকতেন। বাসার ভেতরে হম্বিতম্বি করতেন। শেখ মুজিবকে উপদেশ দিতেন। শেখ মুজিব হাসি মুখে তাদের সহ্য করতেন। তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা স্লোগান দিতে দিতে বাসা থেকে বের হতেন। ভাবখানা এমন তাদের ছাড়া শেখ সাহেবের চলে না। শেখ মুজিব তেড়িবেড়ি করলে এখুনি তাকে বসিয়ে দেবেন তারা। ওইসব নেতার কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। তারা এখন গালগল্প করেন। টকশোতেও যান।
এতো কথা বলার মানে হলো, একটি আন্দোলন একটি দলের জন্য অনেক স্পর্শকাতর সময়। খুবই নাজুক একটি কাল। এই সময় আগাছারা দ্রুত বড় হতে চায়। তারা দ্রুত বর্ধনশীল।
রাজনীতি করার জন্য আগাছার দরকার হয় না। রাজনীতি করার জন্য নেতা দরকার। অফিস স্টাফরা রাজনৈতিক কারণে নিয়োগ হয় (অবশ্যই তারা সর্বোচ্চ দলীয় অনুগত হয়)। হয়তো নেতার পাশে থাকে বলে তারাও যার যার এলাকায় নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায় একসময়। কিন্ত দলীয় প্রধানদের উচিত এসব ‘স্টাফ নেতা’দের তাদের দায়িত্ব কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়া।
কিছু দিন আগে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধান অমিত শাহ বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে ফোন করেছেন বলে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের আরেক স্টাফ মারুফ কামাল খান বিবৃতি দেন। শুনেছি স্থায়ী কমিটির কোন নেতার সাথে পরামর্শ করা ছাড়া, কোন আলোচনা ছাড়াই ইচ্ছেমতো বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। দলের কোন ব্যাপারটি প্রচার করতে হবে, কোনটি গোপন রাখতে হবে, কোনটি মুরুব্বীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে- এসব জ্ঞান সাধারণত স্টাফদের থাকে না। পরে আমরা জেনেছি পুরো ফোনালাপটি ভুয়া ছিল। ফোনালাপটি সত্য হলেও তা বিবৃতি দিয়ে প্রচার করা দরকার ছিল কি না তা বোধগম্য নয়। খালেদা জিয়ার অফিস স্টাফরা এককভাবে এমন বিবৃতি দিচ্ছেন অহরহ।
বিএনপিপন্থি সাংবাদিক এবং অফিস স্টাফ ছাড়াও তারেক রহমানের উপদেষ্টা টাইপ আরেক গ্রুপ আছে, যারা বিএনপির ক্রান্তিকালে নিজেদের জাহিরে ব্যস্ত রয়েছেন। সম্প্রতি তারেক রহমানের একজন উপদেষ্টা ৬ মার্কিন কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জাল করে প্রত্রিকায় বিবৃতি পাঠিয়েছেন। কার সঙ্গে কী পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি বা তারা এসব কাজ করেছেন তা জানা যায়নি।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা এখন কার্যত নীরব। বা তাদের অক্ষম করে রাখা হয়েছে। রুহুল কবির রিজভী ছাড়া আর কোন নেতাকে মূলত দেখা যায় না। সাদেক হোসেন খোকা, মির্জা আব্বাস, তরিকুল ইসলাম, মওদূদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, নজরুল ইসলাম খান, ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এদের এখন দেখা যায় না। না মিডিয়ায়, না সেমিনারে। কালে ভদ্রে হান্নান শাহ, গয়েশ্বর বা রফিকুল ইসলাম মিয়াকে দেখা যায়। তাও টিভিতে, টকশোতে। দলে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তাদের আদৌ কি কোন ভূমিকা আছে? খালেদা জিয়া বা তারেক জিয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো এককভাবে দিয়ে থাকেন। কিন্তু এর বাইরে? এর বাইরেওতো দলের বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ আছে। এগুলো কাদের পরামর্শে চলে। অফিস স্টাফরাই চালাচ্ছে বিএনপিকে? বিএনপি আসলেই চালাচ্ছে কারা? বিএনপির আন্দোলনে চালাচ্ছে কোন নেতারা সেটাও প্রশ্ন হতে পারে।
আমি চোখ রাখছিলাম চলমান আন্দোলনে হামলার সময় হাতে নাতে ধরা পড়ছে কারা তাদের উপর। তারই কয়েকটি নমুনা দিলাম নিচে:
শতাধিক ককটেলসহ বনানীতে শিবিরের ৫ নেতা-কর্মী গ্রেফতার। (২০.০১.১৫)
নোয়াখালীতে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের সময় শিবিরের ৩ কর্মী গ্রেফতার (২৩.০১.১৫)
রাজশাহীতে আগুন দিয়ে পালানোর সময় শিবির কর্মীদের গণপিটুনি। (২৩/০১/১৫)
কক্স'বাজার ও ঝালকাঠিতে বিএনপি-শিবিরের ৪ কর্মী পেট্রোল বোমাসহ আটক। (২২/০১/১৫)
বগুড়ায় ৪ হাতবোমাসহ শিবির কর্মী গ্রেফতার(০৯/০১/১৫)
রাজশাহীতে পুলিশ পেটানো ৩ শিবিরকর্মী গ্রেফতার। (০৯.০১. ১৫)
রাজশাহীতে শিবির কর্মী বোমা এক্সপার্ট কালু গ্রেফতার ( ২২.০১.১৫)
লোহাগড়ায় বোমা হামলার সময় ট্রাক চাপা পড়ে শিবির কর্মী নিহত। (১৪.০১.১৫)
বগুড়ায় ককটেলসহ ১০ শিবির কর্মী গ্রেফতার (২৩.০১.১৫)
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় যাত্রীবাহী একটি বাসে আগুন দেওয়ার সময় তিন শিবির কর্মীকে হাতেনাতে আটক করেছে জনতা। (২৪.০১.১৫)
বিএনপিকে চালাচ্ছে কারা আসলে?
মনোয়ার রুবেল: অনলাইন এক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট, ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫