সকালটা জেগেছিল বিষন্নতায়। শোকে, শঙ্কায়, লজ্জায়, ক্ষোভে ও বিপর্যয়ে।
আমার পিএইচডির ছাত্র ডা. ইকবাল কবির খবরটা শুনেই ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছে। দীপন ওর খুব পরিচিত। বাসায় ঢাকা থেকে আগত দু’জন বিশিষ্ট অতিথি ছিলেন দীপনদের পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ। খালাম্মার বড় মেয়ে আর দীপন প্রায় সমবয়সী। মৃত্যুর খবরে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। উদাস চোখে বারান্দায় বসে থাকলেন কিছুক্ষণ।
দীপনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। কিন্তু আমি তাকে চিনি। এই প্রজন্মের শানিত চেতনার অধিকারী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক মেধাবী প্রকাশক। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। আমি জানি না তিনি কোন রাজনীতির সমর্থক? এই মুহূর্তে তা জানবারও প্রয়োজন নেই।
শুধু জানি, অকালে পুত্র হারিয়ে শোকের সাগরে নিমজ্জমান তিনি এক হতভাগা পিতা। আর কে না জানে, পিতার কাঁধে পুত্রের মরদেহ পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী। অসুখ-বিসুখে কিংবা দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও না হয়, এক ধরনের সান্ত্বনা পাওয়া যায়। তাই বলে মধ্যযুগীয় কায়দায় এইভাবে খুন!
পুত্রকে হারিয়ে শোকে পাথর বনে যাওয়া অধ্যাপক বাবার প্রতিবাদটি ছিল ব্যতিক্রমী এবং তীব্র। তিনি সন্তান হত্যার বিচার চাননি, চেয়েছেন মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। তার বিশ্বাস, শুভ বোধের আলোয় দূর হয়ে যাবে অনাকাঙিক্ষত সব অন্ধকার। প্রতিবাদহীনতার এই তীব্র প্রতিবাদের ভাষা সবার বোঝার কথা নয়, বিশেষ করে যাদের মগজে ঘাটতি আছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দেশে কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই পারস্পরিক দোষারোপের খেলা শুরু হয়ে যায়। এর ফলে প্রকৃত অপরাধীরা পালিয়ে যাবার পথ সুগম হয়। অপরাধ তদন্তে নিয়োজিত বাহিনীগুলো বিপাকে পড়ে। আর প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই এই ব্লেম গেমের কাজে পারদর্শী কিছু নেতা আছেন। আওয়ামী লীগেও এদের আবির্ভাব ঘটেছে। ব্লেম গেমের এই খেলায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
তারপরও অবাক হই দীপনের বাবার অসাধারণ প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল-উল আলম হানিফের প্রতিক্রিয়ায়।
হানিফ এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী বলেই পুত্র দীপন হত্যার বিচার চাননি বাবা আবুল কাসেম ফজলুল হক। একজন পুত্রহারা পিতা সন্তানের বিচার চায় না, এটা বাংলাদেশে প্রথম। পৃথিবীতেও আমি এমনটা দেখিনি। যে পুত্র হত্যা হয়েছে তার বাবা অধ্যাপক সাহেব হয়তো ওই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত উনার দলের লোকজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান না বলেই তিনি এ ধরনের কথা বলেছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাকর। ’
পৃথিবীর অনেক কিছুই যে হানিফ সাহেব দেখেননি, সেটা তার কথাবার্তা আর আচরণেই বোঝা যায়। যদিও বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের তোপের মুখে রাতে তিনি আমতা-আমতা করে নিজের বক্তব্যের একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। কী জানি? তিনি হয়তো নিজের মতো অন্যদেরও 'অগভীর নলকূপ' ভাবেন। তার ধারণা তিনি যা-ই বলবেন আমরা তাই মেনে নেবো। আমজনতা কী সব গরু-গাধা পর্যায়ের?
সাত-আট বছর আগে এক পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করার কথা। ফোন দিতেই বললেন, ঢাকা ক্লাবে চলে আসেন। গিয়ে দেখি আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচিত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ সাহেবের সঙ্গে সাংবাদিকদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য মতবিনিময় ধরনের অনুষ্ঠান, সেই সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ।
দেরিতে যাবার জন্য খাবার প্রায় শেষের পথে। তবে সে জন্য নয়, সেখানে গিয়ে মন খারাপ হয়েছিলো অন্য একটি কারণে। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন এমন একজন, যাকে সাংবাদিকরাই তেমন চেনেন না। তবে আনন্দিতও হয়েছিলাম এই ভেবে যে, নিশ্চয়ই তিনি সেই রকম ক্যারিশমাটিক নেতা হবেন। রাজনীতিতে সতেজ তারুণ্যের দাবি তো প্রায়শই আমরা করে থাকি।
এর পরে খুলনায় গিয়ে জানলাম আমার শৈশবে তিনি (হানিফ) আমাদের পাড়াতেই থাকতেন। শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে আলম কাকা, মাহবুব কাকাসহ আরও কত মুখ মনে পড়ে। কিন্তু কিছুতেই মাহবুব-উল আলম হানিফকে কথা মনে করতে পারি না।
সে সময়ে আমাদের পাড়ায় খুবই ‘অনুল্লেখ্য’ একটা নাম ছিল। সেটা অবশ্য দোষের কিছু নয়। কত মানুষই তো জীবনের কত বাঁকে এসে ‘উল্লেখ্য’ হয়ে ওঠেন। দিন যায়, বছর যায়, কিন্তু মাহবুব-উল আলম হানিফদের কোনো বৈশিষ্ট্য আমাদের চমৎকৃত করে না।
শুধু মাঝে মধ্যে বিরক্তিকর কথাবার্তা আর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের নিজ দলে ভিড়িয়ে সমালোচিত হওয়া ছাড়া দল ও দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য কী অবদান রাখছেন তা খুঁজে বের করতে হলে মাইক্রোস্কোপ লাগবে হয়তো।
লেখাটির এই পর্যায়ে এসে বন্ধু মফিজের বিয়ের ঘটনাটা মনে পড়ছে খুব। তখন কেবল ইন্টার্নশিপ শেষ করেছি। বন্ধুদের অনেকেরই বিয়ে হচ্ছে, বিয়ের অনুষ্ঠানে দল বেধে সবাই গিয়ে হই-হুল্লোড় করছি। এমন সময়ে সহপাঠী মফিজের বিয়ে ঠিক হলো। পাত্রী প্রবাসী।
স্বল্প সময়ের জন্য দেশে আসবেন, তাই খুব তাড়াহুড়া করেই সব আয়োজন। নির্ধারিত দুপুরে বন্ধুরা সবাই মিলে পল্টনের কস্তুরী হোটেলে হাজির। মানুষ হিসেবে মফিজ অসাধারণ, প্রবাসী পাত্রীও দেখতে অপরূপা। সব মিলিয়ে একেবারে সোনায় সোহাগা।
এক সময়ে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। বর-কনে দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হল কথাবার্তা। এক কথা-দুই কথায় বেধে গেল তুমুল হট্টগোল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতভম্ব। এমন সময় বরপক্ষের একজন উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘এই বিয়ে হইবো না। মোগো মফিজের কি দ্যাশে মাইয়ের অভাব। ’ এই বলতে বলতে বিয়ের আসর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন তিনি।
মাহবুব-উল আলমদের কথাবার্তা-আচরণে মনে আজকাল প্রশ্ন জাগে- ‘আওয়ামী লীগে কী নেতার অভাব?’
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন: কবি ও চিকিৎসক, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০১৫
টিআই