ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা || সাজেদা সুইটি

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪২ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১৬
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা || সাজেদা সুইটি

গল্পটা আম্মুকে নিয়ে। তবে নানুর মুখে শোনা।

আমার মা তখন ছোট্ট শিশু। একাত্তরের মু্ক্তিযুদ্ধকালে আমার রেলওয়ে প্রকৌশলী নানাভাই শহর থেকে  গ্রামে চলে গিয়েছিলেন নিরাপত্তার খোঁজে। সেখানেই একদিন রাস্তার পাশে খড়-কাঠি নিয়ে খেলছিলেন শিশু আম্মু। ক’জন মুক্তিযোদ্ধা তখন সেপথে যাচ্ছিলেন। আম্মুকে জিজ্ঞেস করলেন ‘মা, কী করিসরে তুই?’

আম্মুর জবাব, ‘মুক্তিফৌজ বানাই। ’

সমস্বরে হেসে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আম্মুর হাতে একটা কয়েন দিয়ে দলনেতা বলেছিলেন, 'বানা, মা, মুক্তিফৌজ বানা!'

আড়াল থেকে নানু সব দেখছিলেন, যুবারা চলে গেলে আম্মুকে কোলে নিয়ে ছুটলেন অন্দরমহলে।

নানুর কাছেই শুনেছি, রেলওয়ে প্রকৌশলী নানাভাইকে গ্রামে গিয়েও বেশ ক’বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে যুদ্ধবিরোধীদের হাতে। কিন্তু ভাগ্যজোরে বেঁচেও এসেছেন।

সেসব গল্প নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলতেন নানু।

এবার বাবার গল্প বলি। এটি বড় ফুফুর কাছে শোনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার কিশোর বাবা লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়েছিলেন তাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাবেন বলে। কিন্তু আব্বুর বয়স কম বলে তারা ফিরিয়ে দিলো। কিছুদিন পর আবার গেলেন। পরিচিত এক বড় ভাই বকা দিলেন আব্বুকে। বললেন, খালি বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। চাচী বিধবা মানুষ, তারে কে দেখবো? তুই ছাড়া কেউ আছে তার? পরে লাগলে তোরে ডাকবো। এখন বাড়িতে যা।

মন খারাপ করে চলে এসেছিলেন আব্বু। পরে তার যুদ্ধটা ছিলো অন্যরকম। দাদুর মুখে শুনেছি, লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার-ওষুধ দিয়ে আসতেন আব্বু।

মুক্তিযোদ্ধার মুর্তি বানানো আমার মা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা আমার বাবারই সন্তান আমি। দৃঢ়ভাবে বলতে পারি আমার মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেক গভীরভাবেই প্রোথিত।

আর মহান স্বাধীনতার দিবসেই আমার জন্ম। তাই স্বাধীনতাতো আমারই।

খাঁচায় বন্দী পাখিকে তার নিজের আকাশে উড়ে বেড়ানোর নিশ্চয়তা দেওয়া আর রক্ত দিয়ে হলেও নিজের দেশের মালিকানা বুঝে নেওয়া- দুটোই স্বাধীনতা। এটাই আমার বোধ।

কোনও এক ২৬ মার্চের ঘটনা। জন্মদিন আমার। নতুন পোশাক, জুতো পরিয়ে আম্মু-আব্বু আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে নানুবাড়ি চললেন। পথে চোখে পড়ে ছেলেমেয়েরা ছুটির দিনেও স্কুলে এসেছে। পতাকা উড়ছে, মাইকে গান হচ্ছে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

ওরা কেন এত আনন্দ করছে? সে প্রশ্নে আব্বু বললেন, আজ তোমার যেমন জন্মদিন, এটি বাংলাদেশেরও জন্মদিন। এই দিনেই আমরা স্বাধীন হয়েছি।
সেই ছেলেবেলা মাথায় গেঁথে যাওয়া বাবার কথাগুলো আজও ভুলিনি।

আব্বু সেদিন বুঝিয়ে বলেছিলেন, এ দেশটা আমাদের। কিন্তু বিদেশিরা আমাদের দেশটাকেই নিজেদের করে নিতে চেয়েছিল। তারপর বড় যুদ্ধ হলো। অনেক মানুষ শহীদ হলেন। একসময় বিদেশিরা আর পারলো না, যুদ্ধে হেরে গেলো। আমরা স্বাধীন হলাম।  

আব্বুই বলেছিলেন, সবুজ ঘাসে শহীদের লাল রক্ত পড়ে যেমন দেখাতো, আমাদের পতাকাটি তেমন।

আমার দাদুকে নিয়েও একটা গল্প আছে। দাদু গরুম মাংস খেতেন না। কেন যে খান না, তা ছোটবেলায় বুঝতাম না। অনেক পরে জেনেছি ৭১ এ যুদ্ধের মাঝামাঝিতে বাড়ির কাছেই লোকজনের চিৎকার শুনে সবাই ছুটে যায়। দাদুও গিয়েছিলেন।

একজন আর্তনাদ করছিলেন, তাকে দেখে চেনার উপায় ছিল না। সারা শরীরের মাংস খুবলে খুবলে তোলা হয়েছে ধারালো কিছু দিয়ে, গরুর মাংসের মতো শরীর থেকে ঝুলছিল কাচা মাংস। এরপর থেকে গরুর মাংস দেখে সেই দৃশ্য চোখে ভাসতো। আর সে কারণেই তিনি মাংস খান না।

সেবার আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন বদরপুরের দাদী। এক সন্ধ্যায় সে দাদী গল্প করছিলেন, যুদ্ধের সময় তাদের পাশেই ছিল একটি হিন্দু বাড়ি। অনেক হৃদ্যতার সম্পর্ক সবার সঙ্গে। যুদ্ধ সব বদলে দিল। সোনা-রূপা এর-ওর কাছে রেখে তারা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু যার কাছে সেসব রেখে গেছেন, সে বিশ্বাস রাখে নি। সবই দখল করলো। পরে এলাকার নামকরা ধনীও হলো।

আমার এক ফুপার মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হলো। অনেক গণ্যমাণ্য মানুষ এসেছিলেন জানাযায়। সেদিন জেনেছিলাম, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সেদিন থেকে আমার মৃত ফুফাকে নিয়েই বুকের মধ্যে অনুভব করি আলাদা গর্ব।

এভাবেই অর্জনের প্রতিটি গল্প আমার মস্তিষ্কে থরে থরে সাজানো আজও।

আব্বু বলেন, যুদ্ধ শেষ হয়, আবার হয়ও না। দেশের কথা ভেবে ভালো কাজ করবে। সেটাও মুক্তিযুদ্ধের মতো বড়কাজ, অনেক পবিত্র কাজ। সততা, সত্যবাদিতা, পরিশ্রম, এগুলোও মুক্তিযুদ্ধ, মা!

বড় হয়ে ইতিহাসেরর আরও কতকিছু জেনেছি। সংবাদকর্মী হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর যুদ্ধ নিয়ে রাজনীতির কাঁদাছোড়াছুড়ি দেখেছি।

কিন্তু সেসবে প্রভাবিত হয় না মনটা। মনের ভেতরে দাদুর মাংস না খাওয়ার কারণ, আমার শিশু মায়ের মুক্তিফৌজ গড়ার গল্প, আমার কিশোর বাবার লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো সাহসী কাজের স্মৃতি।

আমার স্বাধীনতার ছোট্টবেলার এসব স্মৃতির মধ্যেই টিকে আছে। থাকবে চিরকাল।

জাতীয় সঙ্গীতে আপ্লুত হয়ে যখন দেশের মানুষ কাঁদে, সেটাই আমার স্বাধীনতা। ক্রিকেটের জয়ে রাস্তায় পতাকা নিয়ে ছোটা উচ্ছাসই আমার স্বাধীনতা। বইমেলায় গিয়ে প্রিয় বইটি সস্তায় পেতে দরদাম করে যে তরুণ, সেই এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার দুর্বিষহ জ্যামে বসেও রিকশাওয়ালা ও যাত্রীর যৌথ 'ছক্কা' চিৎকার, সেটাই এই স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ আনন্দ।

মন বলে, 'দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়!'

লেখক: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৩ ঘন্টা, মার্চ ০৫, ২০১৬
এসকেএস/এমএমকে

সোনালী চেতনার সৌম্য অভ্যুত্থান || মাহমুদ মেনন
এ দেশ গভীর ভালোবাসা ও বন্ধনের || মুফতি এনায়েতুল্লাহ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।