ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাকিশয়তানেরা! || সেরাজুল ইসলাম সিরাজ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৬
পাকিশয়তানেরা! || সেরাজুল ইসলাম সিরাজ

আমার কাছে স্বাধীনতা মানে, অফিসার পদে বাঙালির নিয়োগ। আমার কাছে স্বাধীনতার মানে, উন্নয়ন বঞ্চিত বাংলার সুদাসলে উপভোগ।

স্বাধীনতার আরেক মানে, চিনি ও পাটকল স্থাপন। মোদ্দা কথা- নিজের দেশে, নিজের দ্বারা শাসন।
 
বাবার কাছেই আমার স্বাধীনতার প্রথম পাঠ। যতদূর মনে পড়ে, যখন সবেমাত্র একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি- তখনই তিনি আমাদের ভাই বোনদেন স্বাধীনতার গল্প শোনাতেন। কেন শোনাতেন তখন খুব একটা বুঝতে না পারলেও আজকে ঠিকই অনুধাবন করতে পারি অন্তর্নিহিত মর্মার্থ।
 
বাবা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতেন। বাবা পুঁথি পড়তে ভালো বাসতেন। কোনো কোনদিন সন্ধ্যার পর সুর করে পুঁথি পাঠ করতেন। আমরা ভাই-বোনরা উঠোনে গোল হয়ে বসে শুনতাম। অবশ্য ওই দিনগুলোতে মৌসুমী ফল অথবা পিঠার আয়োজন থাকত। এই সন্ধ্যাগুলোতে লজিং মাস্টারের কাছে বেশিরাত পর্যন্ত পড়তে হতো না। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের বুক ধড়াস সন্ধ্যাবেলাবিহীন মুহূর্ত কাটতো। যে কারণে ঈদের আমেজ বিরাজ করতো আমার মনে।
 
বাবা বলতেন, বাংলাদেশের লোকজনকে বড় অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া হতো না। আমাদের লোকজনকে চাকরি দেওয়া হতো পিয়ন-দারোয়ান পদে। আর পাকিস্তানের লোকজনকে অফিসার পদে। পাকিস্তানি অফিসাররা বাংলাদেশের লোকজনকে অকারণে নির্যাতন করতো।
 
বাংলাদেশে আখ চাষ হয়। আর সেই আখ মাড়াইয়ের জন্য চিনিকল বসানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশ থেকে জাহাজে করে আখ নেওয়া হয় পাকিস্তানে। সেখানে চিনি তৈরি করে বাংলাদেশে এনে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। আর পাকিস্তানে কমদামে চিনি বিক্রি করা হয়।
 
বাংলাদেশে তখন জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৯৬ লাখ আর পাকিস্তানে ছিল ৫ কোটি ৮০ লাখ। কিন্তু উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানে ব্যয় হতো ৭০ শতাংশ আর বাংলাদেশে ব্যয় হতো মাত্র ৩০ শতাংশ। এই নিয়ে বাঙালির মনে ক্ষোভ ছিল। নির্বাচন পরবর্তী বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা না দেওয়ার ঘটনা প্রবাহ এবং আগরতলা মামলার ঘটনাবলীর বর্ণনা করতেন বাবা।
 
যুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলো সম্পর্কে তার মুখ থেকে অ আ শেখা। জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতীয় সীমান্ত হিলি বর্ডার দিয়ে পার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পার হতে পারেননি। একদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। বাবাসহ ২৫/৩০ জনকে লাইনে দাঁড় করা হয়েছিলো। একজন অফিসার এসে পিঠে গুতো দিয়ে বলেছিলো- হট যাও।
 
আমাদের বাড়িতে না-কি মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মধ্যেই রাত্রী যাপন করতেন। বলা যায়, সাব ক্যাম্প হিসেবে আমাদের বাড়িটিকে ব্যবহার করতেন তারা। কিছু অস্ত্রসস্ত্র থাকতো। যুদ্ধের পরও থেকে যায় বেশ কিছু মাইন। পরে সেগুলো অন্যকাজে ব্যবহৃত হতে দেখেছি।
 
সাতাশির বন্যার পর আমাদের এলাকায় ব্যাপকহারে চুলকানির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন বারুদ পাউডার করে নারিকেল তেল মেখে ঘায়ে লাগানো হতো। আমিও ছিলাম এর উপভোগী। সেই যন্ত্রণা আজও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। জোর করে লাগিয়ে দেওয়া হতো দগদগে ঘায়ে। জীবন ধ্বংসী বারুদের এই গুণের খবর দ্রুতই রটে যায় এলাকায়। আর একটু একটু করে বিতরণ করতে করতে শেষ হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ স্মৃতিটুকু।
 
কাগজে কলমে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা সম্পর্কে জেনেছি গুপিনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান স্যারের কাছে। তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের জীবনী পড়াচ্ছিলেন আমাদের মতিউর স্যার।
 
ক্লাসের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রী পেয়ারা খাতুনকে বলেছিলেন রিডিং পড়তে। পেয়ারা খাতুন রিডিং পড়তে পারলেও যুক্ত শব্দের উচ্চারণ করতে পারতেন না। পড়ার সময় পাকিস্তানিরা না পড়ে পাকিশয়তানেরা উচ্চারণ করেন।   আর সেই উচ্চারণ শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম আমরা অনেকে।
 
এ জন্য মতিউর স্যার বেজায় চটেছিলেন।   চুপ বলে গগণ বিদারী হাঁক ছেড়েছিলেন। এর আগে কখনও এমন অগ্নিমূর্তি দেখিনি তার। স্যার পেয়ারা খাতুনকে বললেন- তুমি পড়ে যাও। পেয়ারা খাতুন পুরো গল্পটিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থানে প্রতিবারেই পাকিশয়তানেরা পড়ে শেষ করেন।
 
পেয়ারা খাতুনের পড়া শেষে স্যার আমাকে বললেন বেত আনার জন্য। স্কুলের পেছনে ছিল এক ধরনের ঝোপ জাতীয় গাছ- যাকে রংপুরের স্থানীয় ভাষায় কষি/দোমড়া বলে জানি। গাছগুলোতে বাইসাইকেলের বলের সমান ফল ধরতো। যেগুলো কাঁচা খেতে হালকা টক লাগতো। আবার পাকা বেগুনী  বর্ণের  কষি খুবই মজাদার লাগত।
 
কষির লিকলিকে ডালগুলো ছাত্রদের পিটুনি দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। স্যারের নির্দেশমতো সেই কশির ডাল ভেঙ্গে আনার পর প্রথমে আমাকে দিয়ে পেটানো শুরু করেছিলেন। আমাদের অপরাধ ছিল আমরা শ্রেণি কক্ষের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছি।
 
মতিউর স্যার গণহারে পিটুনি দেওয়ার পর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ও (পেয়ারা খাতুন) ঠিক বলেছে। বইয়ে ভুল রয়েছে। পাকিস্তানিরা না বলে পাকিশয়তানেরা হওয়া উচিত ছিল। কারণ, ওরা মানুষ ছিল না। ওরা শয়তানের চেয়েও ‍খারাপ ছিল। ওরা যা করেছে তা কোন মানুষ করতে পারে না।
 
ওরা গ্রামের গরীব লোকের গরু ছাগল তুলে নিয়ে জবাই করে খেয়েছে। সুন্দরী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। মায়ের সামনে মেয়ের ইজ্জত লুটেছে। অনেকের সুখের সংসার ছারখার করে দিয়েছে। সুজারকুটি গ্রাম (স্কুল থেকে দুই কিলোমিটার দূরের গ্রাম) আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওদের মানুষ বলি কেমনে।
 
বলতে বলতে আবেগকাতর হয়ে পড়েছিলেন মতিউর রহমান স্যার। পরের ক্লাসে ভয়ে আমরাও পাকিশয়তানেরা পড়েছিলাম। কিন্তু স্যার সেদিন সংশোধন করে দিয়েছিলেন।
 
স্কুলে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য প্রথমে নাম ছিল আমার। কেনো যেনো আমিও উন্মুখ হয়ে থাকতাম জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য। গলা ছেড়ে গাইতে ‍পারলে মনটা অনেক হালকা লাগতো। সবার আগে স্কুলে গিয়ে পতাকা উত্তোলন করা ছিল আমার রুটিন কাজ।
 
আমি প্রাইমারি শেষে যখন হাইস্কুলে পাড়ি জমিয়েছি- তখন বিএনপি ক্ষমতায়। আমাদের বাড়িতে তখন নিয়মিত দৈনিক সংবাদ পত্রিকা রাখা হতো। পত্রিকা কখনো সন্ধ্যায়, কোনদিন মধ্যরাতে পৌছুতো। কখনও কখনও পরদিন পাওয়া যেতো আগের দিনের পত্রিকা। সেই পত্রিকায় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালতের খবরগুলো বড় বড় করে লেখা থাকতো। সঙ্গে উপ-সম্পাদকীয় এবং কলাম থাকতো- সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম।
 
কলেজে যাওয়ার পর তো নেশাই হয়ে গেছিলো কলাম পড়ার। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর কলাম খুঁজে খুঁজে পড়তাম। সবচেয়ে কষ্টের সময় গেছে ২০০১ সালে জামায়াত নেতারা যখন মন্ত্রিসভা সদস্য হলেন। যারা আত্মস্বীকৃত রাজাকার ছিলো, যারা বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিলো- এমনকি আজও যারা তাদের সেই অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। বরং বুক উঁচিয়ে বলে সেই বিরোধিতার কথা।
 
তখন একরকম হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিলাম। ভাবতাম, এই বুঝি রাজাকারদের হাতেই দেশ চলে যাচ্ছে। যেভাবে রাজশাহীসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের আধিপত্য। তাতে খুবই কষ্ট লাগত। এমনকি ছাত্রদল যখন পিটুনি খেয়ে বিড়াতিড় হতো তখন খুবই ভয় হতো। সামনে কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
 
তখন সব কিছুই যেনো বিষাদময় হয়ে যাচ্ছিল। ২০০৩ অথবা ২০০৪ সালের ঘটনা। আমি তখন দৈনিক সংবাদের পীরগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি। বিজয় দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান কভার করতে গেছি। দেখি সভামঞ্চে আসন নিলেন জামায়াত নেতা মওলানা সাখাওয়াত হোসেন। একাত্তরে যার ভূমিকা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। প্রতিবাদে আমরা কয়েকজন ‍সাংবাদিক সেদিন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জন করেছিলাম।
 
জামায়াত বিএনপির সেই মধুচন্দ্রিমার দিনগুলোতে অনেকে বলা বলি করতেন, আর কিছুদিন গেলে মুক্তিযোদ্ধারা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। রাজাকারের বিচার তো হবেই না। উল্টো পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হবে। কিছু ছদ্মবেশীকে বলতে শুনতাম পাকিস্তান থাকলেই ভালো ছিল। দেশটা অনেক সমৃদ্ধ হতো। আর তখনই তর্ক বেঁধে যেতো।
 
অনেক পথপরিক্রমার পর যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলো- তখনও বিশ্বাস করতে ভয় হচ্ছিল। সত্যি সত্যি বিচার হবে তো! গোলাম আজম-সাকাদের ধরতে পারবো তো! গ্রেফতার করলে তাদের পেতাত্মারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে নাতো! সরকার পেতাত্মাতের সামাল দিতে পারবে তো!
 
অনেকগুলো তো এবং যদি আমার মধ্যে কাজ করতো। মাঝে বিচার বিলম্বে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। মনে হতো আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে আ‍ঁতাত করছে না-তো। কিন্তু কয়েকটি রায় কার্যকর দেখে এখন আমি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তো এবং যদি সব উবে গেছে। এখন মনে হয় সব বিচার হবে। রিভিউয়ে সাঈদীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে।
 
এখন আমি এমন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে ৩০ লাখ বাঙালি অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। সামনে মাইন পাতা জেনেও দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলো। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ একদিন মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে যাবে।

রাজনীতির নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা থাকবে না। মিটিংয়ের নামে পল্টন কিংবা জিরোপয়েন্টে রাস্তা অবরোধ থাকবে না। ন্যায্যমূল্যে সব পণ্য পাওয়া যাবে। জনগণ সংসদের মেয়াদান্তে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে জয়যুক্ত করবে।
 
যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে। তাদেরও একদিন বিচারের মুখোমুখি করা হবে। বাংলাদেশের মুক্ত বাতাস শুধু সাচ্চা দেশ প্রেমিকরাই উপভোগ করবে।

লেখক: চিফ অব করেসপন্ডেন্টস, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।