ভেবেছিলাম, মৃত মানুষ নিয়ে আর কলম ধরবো না। শিশু জেহাদ নিহত হওয়ার পর আর সে ঘটনার বর্ষপূর্তিতে হাত নিশপিশ করেছিল, কিন্তু কলম ধরিনি।
বাংলাদেশের ফরেনসিক বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞান অংশটি যেন ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। জনগণকে মুর্খ ভেবে আমাদের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তাদের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে একদিকে যেমন ভুক্তভোগীদের বিচার থেকে বঞ্চিত করছেন, অন্যদিকে জনমনে এ বিষয়ের ওপর মানুষের আস্থা লোপ পাচ্ছে। এ প্রথা প্রতিহত না করলে সমগ্র বিষয়ে সমূহ বিপদ অনিবার্য। মেডিকেল শিক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি (ফরেনসিক মেডিসিন) বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন প্রমাণের অভাবে দোষী ব্যক্তিরা ছাড়া পেয়ে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবেন, নতুন নতুন অপকর্মে জড়াবেন। তা দেখে আরও অনেকেই তাদের পথ ধরবেন।
প্রধান বিচারপতি স্বয়ং এটি বুঝতে পেরেই আইনের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। ময়না তদন্তের ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে এখন আমাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, ভুল থেকে নেওয়া শিক্ষাই তো ব্যবহারিক শিক্ষা!
খবরের কাগজে সোহাগী জাহান তনুর ঘটনা যতোটুকু জেনেছি তা হল, টিউশনি শেষে বাসায় ফেরার পথে যে সন্ধ্যায় তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেই রাতেই তার মৃতদেহ ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের এক জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়।
গুজবের বিস্তর ডালপালা গজালেও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ময়না তদন্তে মৃত্যুর কারণ আর তিনি ধর্ষিতা ছিলেন কি-না, এ দু’টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছিল। সম্প্রতি খবরের কাগজের মাধ্যমে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় প্রধানের বক্তব্যে দেখলাম। তিনি বলেছেন, মৃত্যুর কারণ বা ধর্ষণের আলামত কোনোটাই পাওয়া যায়নি। তিনি আগ বাড়িয়ে আরও জানিয়েছেন, পৃথিবীর প্রায় দুই থেকে পাঁচ শতাংশ ময়না তদন্তে মৃত্যুর কোনো সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যায় না।
অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে সত্য কথাই তিনি বলেছেন। যা তিনি বলেননি, তা হলো, যেসব ময়না তদন্তে মৃত্যুর কোনো সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যায় না, সেগুলোর ভেতরে পাশবিক নির্যাতন অথবা ধর্ষণ পড়ে না। আর ধর্ষণ কিংবা পাশবিক নির্যাতনে প্রত্যক্ষ ও বায়োলজিক্যাল প্রমাণাদি এতো বেশি যে, শতভাগ হারে এগুলো নিশ্চিত করা যায়। আর তা নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের সততা আর যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
তাই যদি হবে, তাহলে কি বিনা কারণে সুস্থ, সবল তরুণী তনুর কি মৃত্যু হয়েছিল! লোকারডস সূত্রানুযায়ী অস্বাভাবিক মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট আলামত সেখানে থাকবেই। নইলে লোকারডস সূত্র যে মিথ্যা হয়ে যাবে! এটা নির্ণয়ের পারঙ্গমতার জন্যই তো আপনাদের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বলা হয়। অক্ষমতায় সাধারণ ডাক্তারের সঙ্গে আপনাদের পার্থক্য কোথায়?
ময়না তদন্তে মৃত্যুর কারণ আর তনু ধর্ষিতা ছিলেন কি-না- এ দু’টি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হলেও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যখন বলেন, মৃত্যুর কারণ বা ধর্ষণের আলামত কোনোটাই পাওয়া যায়নি তখন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। মৃত্যুর কারণ না পাওয়া গেলে আমরা লিখি, Unascertained (যখন আমার পক্ষে সম্ভব নয়) অথবা Unascertainable (যখন কোনো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের পক্ষে সম্ভব নয়)। আর ধর্ষিতা কি-না- এ প্রশ্নের উত্তরে আদালতকে জাস্টিফিকেশনসহ সরাসরি মতামত দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত, মালয়েশিয়ায় ধর্ষণ পরীক্ষা নারী ও প্রসূতি বিভাগে হয়ে থাকে।
তনুর প্রথম ময়না তদন্তের সময় অপচনীয় দেহে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি! অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা বটে! ধর্ষণ মানে যে বীর্যপাত নয় আর আলামত নেই মানে যে বীর্যের অনুপস্থিতি- এ ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মৃতদেহের বাহ্যিক পরীক্ষা, পরিধেয় বস্ত্রের অবস্থান এবং তাতে যেকোনো ধরনের নিঃসৃত রস যদি থাকে, তা সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করতে হবে।
ভ্যাজাইনাল সোয়াবের বীর্য সন্ধানের পাশাপাশি প্রস্টেট গ্রন্থির নিঃসরণ বা লালা পরীক্ষা বাঞ্ছনীয়। জানতে হবে, কিভাবে, কখন, কোথা থেকে আলামত সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করা হয়েছিল। না হলে ময়না তদন্তকারী ডাক্তারকে সব ধরনের পেশাগত অসদাচারণের আওতায় দাঁড় করানো যেতে পারে।
বলে রাখা ভালো যে, পেশাগত অসদাচারণ তিন ধরনের হতে পারে। সিভিল, ক্রিমিনাল আর এথিকাল। এক্ষেত্রে কোনো পরীক্ষা করতে ভুলে গেলে সিভিল, কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করলে ক্রিমিনাল আর আলামত সংগ্রহে গাফিলতি বা ন্যূনতম জ্ঞানের অপার্যপ্ততায় এথিকাল অসদাচারণ হতে পারে।
ধর্ষণ কি? মোদ্দা কথায় জোরপূর্বক দৈহিক মিলনকে ধর্ষণ বলা হলেও এর সংজ্ঞায় কয়েকটি যদি আছে। আর আছে যোনিপথে লিঙ্গের নিশ্চিত প্রবেশ করানোর পূর্ব শর্ত। তাই যদি হয়, তাহলে জোর খাটানো অথবা যোনিপথে লিঙ্গ প্রবেশের কোনো আলামত থাকবে না এটা অবিশ্বাস্য। এক্ষত্রে হয় যৌন মিলন হয়নি, না হলে ময়না তদন্তকারী ডাক্তার তা বুঝতে পারেননি অথবা এড়িয়ে গেছেন। যৌন মিলন না হয়ে যদি ধস্তাধস্তিও হয়ে থাকে তাহলে তা কি সেক্সচুয়াল অ্যাসল্টের সীমানায় পড়ে না?
এ জাতীয় মামলায় প্রথম ময়না তদন্ত অতীব জরুরি এবং তা অভিজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানেই হওয়া উচিত। দ্বিতীয়বারের ময়না তদন্ত আইওয়াশের একটা সংস্করণ মাত্র। ফলে সে পথে না গিয়ে প্রথম ময়না তদন্ত প্রতিবেদনের ময়না তদন্তই ছিল বাঞ্ছনীয়।
মনে আছে, বাংলাদেশে হাজারখানেক ময়না তদন্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে যুবক বয়সে আমি যেদিন ওসাকা ইউনিভার্সিটির ফরেনসিক বিভাগে যোগ দিয়েছিলাম, সেদিন জাপানিরা ঈর্ষান্বিত নয়নে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। সেদিন জেনেছিলাম, অনেক জাপানি অধ্যাপক তাদের জীবোদ্দশায় পাঁচশ’ ময়না তদন্তের অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করে যেতে পারেননি। সেখানে প্রথম ময়না তদন্ত দেখার ক্ষণেই আমি বুঝেছিলাম, হাজার খানেক ময়না তদন্তের অভিজ্ঞতা আসলে কাগুজে অভিজ্ঞতা, শুধুমাত্র মরদেহ দেখার অভিজ্ঞতা। আমরা দেশে যে ময়না তদন্ত করি, তা আসলে ময়না তদন্তের গণ্ডিতেই পড়ে না। আর তাই অভিজ্ঞতার খাতা শূন্য ধরেই সেদিন আমার নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল।
সম্প্রতি জাপানের মর্গে প্রবেশ করে আমি আরও অভিভূত হয়েছি। প্রতিটি মর্গই এখন স্ক্যানার সমৃদ্ধ। প্রথাগত ময়না তদন্তের পাশাপাশি ডিজিটাল ময়না তদন্ত করায়ও তারা এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন।
যে দেশের খবরের কাগজ জুড়ে থাকে হত্যা, আত্মহত্যা, খুন, গুম, জখম, ধর্ষণের জনশিহরিত ঘটনা, সেখানে ফরেনসিক মেডিসিনের দৈন্যতা আমাকে কষ্ট দেয়। কিছুদিন আগে ঢাকার সেনা মালঞ্চে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে এক টেবিলে সময় কাটিয়েছিলাম স্বাস্থ্য সেক্টরের সজ্জন ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসানের সঙ্গে। তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগ খোলার ব্যাপারে আমার যুক্তি দেখালাম। তিনি স্থানাভাবের কথা বললেও মেনে নিয়েছিলেন আমার সকল যুক্তি। তাকে বলেছিলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সময় ভাগাভাগি করেও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের কার্যক্রম চালানো সম্ভব। যেখানে যোগ্য বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে স্পর্শকাতর আর জনশিহরিত মৃতদেহের ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে।
আমাদের আলোচনায় যোগ দিয়ে সার্জারির জ্যেষ্ঠ একজন অধ্যাপক ফরেনসিক বিষয়ে তার তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে আলোচনাটাই অসাড় করে দিলেন। আমি সেদিন সেই অধ্যাপককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম, তিনি একজন ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপকের সামনে কথা বলছেন। পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি সত্য। তবে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, ফরেনসিক মেডিসিনের দুর্দশায় এসব অধ্যাপকদের অবদানও কম নয়, যারা নিজ বিষয়ের বাইরে কোনো জ্ঞান রাখেন না অথবা দৃঢ়তার সঙ্গে ভুল তথ্য প্রদান করে অন্য বিষয়ের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেন।
কর্তা ব্যক্তিদের দূরদর্শিতার অভাবে চোখের সামনে নিজ পেশার করুণ পরিণতি দেখতে পারছি! সত্যিকারের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের অভাবে বাংলাদেশের ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ের যে অপমৃত্যু হতে চলেছে, সেদিকে কারও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
যুগে যুগে তনুরা আসেন মাঠ গরম করতে। তাদের আগমনে মাঠে থাকা আগের ইস্যু হারিয়ে যায়। সময়ের বিবর্তনে তনুদের ইস্যুও এক সময় ঢাকা পড়ে। তারা এলে আমাদের নেতারা গর্জে ওঠেন, খুনিদের গ্রেফতারের আশ্বাস দেন। তারপর দিন শেষে তনুদের স্মরণ করার মতো কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন আরেক তনুর অপেক্ষায় আমাদের নেতারা গলায় শান দেন।
ক্ষমতার মসনদে থেকে তারা ভুলে যান যে, অচিরেই এ লাইনে যোগ হতে পারে তার নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যা।
আমি আশাবাদী একজন মানুষ। বিশ্বাস করি, সব সমস্যার সমাধান আছে। আমি যেভাবে সমাধানের কথা ভাবছি, তার চেয়ে উত্তম পন্থাও হয়তো আছে- এ সত্য স্বীকার করে নিয়েই বলছি-
ফরেনসিক বিজ্ঞানকে যুগোপযোগী করতে হবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ফরেনসিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আর উচ্চতর বৈদেশিক ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তা শুরু করা যেতে পারে (এই ট্রেনিং মানে শপিং আর দেশ বেড়ানো নয়। )
জনগুরুত্বপূর্ণ আর জনগণের আগ্রহ সৃষ্টিকারী ময়না তদন্তগুলো যোগ্য ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। মামলায় জড়িত বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বয় সাধন ও নিয়মিত মামলা সংক্রান্ত আলোচনা বা পর্যালোচনা করতে হবে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম: বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি, মারা, মালয়েশিয়া। ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৬
এএসআর