ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কর্নেল তাহেরের সহযোদ্ধাদের প্রতি জয়া তাহেরের আহবান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৬
কর্নেল তাহেরের সহযোদ্ধাদের প্রতি জয়া তাহেরের আহবান

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর উৎপত্তি হঠাৎ করে হয়নি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে জাগরণ গ্রামের কৃষাণ-কৃষাণী, ব্যারাকের সৈনিক আর বিভিন্ন বিদ্যাপীঠের ছাত্র-ছাত্রী তথা সমগ্র মুক্তিকামী বাঙালিকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছিলো, সেই মৈত্রী আর উজ্জীবিত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সবার জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণের অভিপ্রায়ে, রণাঙ্গনের অসম সাহসী একদল বীর মুক্তিযোদ্ধার হাতে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের আত্মপ্রকাশ।

জাসদের বৈপ্লবিক ইতিহাস, স্বতন্ত্র অবস্থান এবং এদেশের গণমানুষের মুক্তির সংগ্রামে দলের নেতাকর্মীদের নির্মোহ আত্মত্যাগ এ দলকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও তার ভবিষ্যতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
 
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিনাশের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র যখন দক্ষিনপন্থীদের হাতে বিপর্যস্ত হচ্ছিল, তখন জাসদই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি যা সরাসরি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার গণঅভ্যুত্থান অল্প সময়ের জন্য হলেও উপনিবেশ উত্তরকালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে পুঁজিপতিদের সরিয়ে দিয়েছিল।

আমরা জানি, সেই বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তারপর দুঃখজনক ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি যে, জিয়া ও এরশাদের সামরিক সরকারের সময়ে জাসদের বিভক্তি। কিন্তু এতো ঝড়ের পরেও ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থান জাসদের তারুণ্য কি রাজপথ কাঁপিয়ে তোলেনি? চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটে ফ্যাসিস্ট শিবিরের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তারা কি প্রতিরোধের দুর্গ রচনা করেনি? কর্নেল তাহের, কাজী আরেফ, ডাক্তার মিলনসহ শত সহস্র প্রাণ, যুগে যুগে জাসদের জন্য বাংলাদেশের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকেনি?

এ প্রেরণার উৎস থেকেই আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই যে, জাসদ শুধুমাত্র ইতিহাসের বিষয় নয়। বরং জাসদের বৈপ্লবিক ইতিহাস আমাদের দেখায় গণমানুষের রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে জাসদের রাজনীতির অপরিহার্যতা।
 
আমরা এমন একটা সময় পার করছি যখন একদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার, আদালতে তাহের হত্যা মামলার রায়, যুদ্ধাপরাধীদের আইনের আওতায় আনা এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, মৌলবাদীদের উত্থান, একের পর এক শিক্ষক, মুক্তমনের চিন্তাবিদ এবং মেহনতি মানুষের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি একটা নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের বিরাজনীতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক প্রগতিশীল শক্তির সীমাবদ্ধতায় গণমুখী রাজনীতির প্রশ্নে পুরো রাজনীতি হয়ে গেছে চরমভাবে অসংগঠিত।

কিন্তু এই সময়ে জাসদের সর্বশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে মাঠ পর্যায়ের জাসদ কর্মীদের বিপুল উপস্থিতি আমাদের কাছে নবজাগরণের আলোর বার্তাই নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারপর আমরা দেখেছি, কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অনভিপ্রেত ঘটনা প্রবাহ সারা দেশের অগণিত কর্মী ও সমর্থকদের মনে গভীর হতাশার জন্ম দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক বিষয়। যে নেতারা সকল প্রতিকূলতার সময়ও এক কাতারে থেকে মাঠ পর্যায়ে কর্মীদেরকে উজ্জীবিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, এখন তারা একটি কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে পৃথক অবস্থান নিয়েছেন। যা আমাদের সবার জন্যই অনাকাঙ্খিত ও মর্ম বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 
এ প্রেক্ষিতে কর্নেল তাহেরের সহধর্মিনী, আমার মা লুৎফা তাহের জাসদ নেতাদের প্রতি ঐক্য প্রতিষ্ঠার আন্তরিক আহবান জানিয়েছেন। আমরা দেখতে পেয়েছি, কি দারুণভাবে সারাদেশ থেকে জাসদের ঐক্য প্রত্যাশী নেতাকর্মীদের আমার মায়ের ডাকে সাড়া দিতে। এরই মধ্যে নেতারা ঐক্যের লক্ষ্যে একাধিকবার একসঙ্গে বসলেও কার্যতঃ কোনো শুভ ফল আসেনি।
 
কর্নেল তাহের ও হাজার হাজার শহীদ সাথীর স্বপ্নে গড়া এই সংগঠন। তারা একটি নতুন শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কর্নেল তাহের তার শেষ চিঠিতেও বলে গিয়েছিলেন, ‘নীতু, যীশু ও মিশুর কথা- সবার কথা মনে পড়ে। তাদের জন্য অর্থ-সম্পদ কিছুই আমি রেখে যাইনি। কিন্তু আমার গোটা জাতি রয়েছে তাদের জন্য। আমরা দেখেছি, শত-সহস্র উলঙ্গ মায়া-মমতা-ভালোবাসাবঞ্চিত শিশু। তাদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় আমরা গড়তে চেয়েছি’।

১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই কর্নেল তাহের ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করে তার দলের প্রতি, তার সহযোদ্ধাদের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করে গেছেন। এই জাসদকে বৃহত্তর পরিবারের অংশীদার করেই আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের সব স্বপ্ন গাঁথা। তাই এর ভাঙনে আপনাদের মতো আমাদের জীবনটাও উলট-পালট হয়ে যায় বার বার।
 
গত কাউন্সিল অধিবেশনের পর থেকে পেয়েছি প্রচুর চিঠি। আপনারা জানিয়েছেন, আপনাদের হতাশার কথা, কষ্টের কথা, মফস্বল শহরে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও তিল তিল করে সংগঠন গড়ে তোলার সংগ্রামের কথা, শহীদের আত্মত্যাগের কথা। আর নেতাদের প্রতি ঐক্য প্রতিষ্ঠার আন্তরিক আহবান জানিয়ে যাচ্ছেন বার বার।

নেতারা কি এ আহবানে সাড়া দেবেন না? আমরা কি আবারো এক বৃহত্তর জাসদ পরিবার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো না? তাই শহীদ তাহেরের মেয়ে হয়ে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মারাত্মক হতাশা দেখে বিবেকের তাড়না থেকে জাসদের সম্মানিত কাউন্সিলরদের এ সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি। আপনাদের যদি আমার মায়ের ঐক্য প্রতিষ্ঠার ডাক অর্থবহ ও জরুরি মনে হয়, এ প্রচেষ্টায় আপনাদের যদি সমর্থন থাকে, তবে বিনীতভাবে নেতাদের কাছে লেখা ঐক্যের আবদেনপত্রে আপনার স্বাক্ষর প্রদান করার জন্য অনুরোধ করছি।
 
জয় আমাদের হবেই। আপনাদের ধন্যবাদ।
 

জয়া তাহের, কর্নেল তাহেরের মেয়ে


বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।