ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’’ নয়!

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৬
‘‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’’ নয়!

সংবাদ প্রকাশে মিডিয়ার ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ সকল মাধ্যমে আছড়ে পড়েছে ঢেউ। ঢেউয়ের ধাক্কায় গোটা মিডিয়া যেন দোদুল্যমান তরী।

ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমও বড় বেশি সরগরম।  

চট্টগ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের হাতে চট্টগামের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর খুন হওয়াটা সাড়া দেশের মানুষের আবেগকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। নিজ সন্তানের চোখের সামনে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডে গোটা দেশ হয়ে পড়েছিল হতবিহ্বল ও শোকস্তব্ধ। তাছাড়া এটা ছিল একটা প্রি প্ল্যান্ড টার্গেট কিলিং। টার্গেট স্বয়ং পুলিশ ও পুলিশের পরিবার পরিজন। দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ছিল বিরল। তাছাড়া বাবুল আক্তার জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমনে রেখে আসছিলেন বড় ভূমিকা। সারাদেশেই তিনি ছিলেন এক ‘হোম নেম’। সম্ভবত সবচেয়ে জননন্দিত তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা। সরকারও তাকে একাধিকবার পুরস্কৃত করেছিল তার পেশাগত দু:সাহস ও সুকর্মের জন্য। সেই বাবুল আক্তারের স্ত্রীর এমন মৃত্যু তাই এ সময়ে ‘‘টক অব দ্য টাউন’’।  

এই বিষয়ে তদন্তের সর্বশেষ খবরটা জানতে তাই সবাই উদগ্রীব। সেটাই স্বাভাবিক। মিডিয়ার কাজও তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি ও গতিপ্রকৃতি সবাইকে জানানো। অনলাইনই এদিক থেকে সবার চেয়ে এগিয়ে। ‘যখন ঘটনা তখনই সংবাদ’—এটাই যেহেতু মাধ্যমের মটো।  

শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে এসপি বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার শ্বশুরের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অনলাইনেই সবার আগে খবর হয়ে আসে। পরে টেলিভিশন এবং এরও বহু পরে তা আসে ছাপার কাগজে। পুলিশ এ ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব ছিল। দীর্ঘ বেশ কয়েক ঘণ্টা পরও পুলিশের নীরবতা কাটেনি। এই সময়ে বাবুল আক্তারের স্বজন পরিজনদেরও জানানো হয়নি তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন। অনলাইনের নিজস্ব সোর্স বা সংবাদসূত্রই সবার গোচরে আনে এই সংবাদ।  

সোর্স-পরিবেশিত তথ্য ‘যাচাই করা না করা’ এবং ফলোআপ ছাপানো নিয়ে বিভিন্ন মহল অনলাইনের দিকে একপেশে বিষতীর ছুড়ে চলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিকতার এথিকস নিয়েও। এই মহলটির কৌতূহল ও রাশি রাশি প্রশ্নের জবাবও আছে যারা সংবাদ ছেপেছেন তাদের কাছে। আর সব সংবাদ যে সুসংবাদ হবে তেমনও নয়। আর কে না জানে এদেশে বা তৃতীয় দুনিয়ায় সংবাদ মূলত দু:সংবাদ বা মনখারাপ করা সংবাদ। সব তথ্য সবার মনপসন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু সংবাদ পেলে তা ছাপানো, মানষকে তা জানানোর কাজ সংবাদ মাধ্যমের।  

সোর্সের দেওয়া সংবাদ সব সময় যে একশোভাগ ঠিক হয় এমনও নয়। সেটা উন্নত দুনিয়ায়ও হয় না। কিন্তু বাবুল আক্তার বিষয়ে পরিবেশিত সংবাদ ভুল ছিল বা ভিত্তিহীন ছিল–এই দাবি কিন্তু এখনো কেউ করেননি। পুলিশ বিভাগও করেনি। সামাজিক মাধ্যমে যারা মিডিয়ার গুষ্ঠি উদ্ধারে নেমেছেন তাদের বেশিরভাগও যতোটা না যুক্তিবোধ দিয়ে চালিত, তারও চেয়ে বেশি চালিত অন্ধ ক্রোধ ও নেতিবাচক মানসিকতা দ্বারা। এ নিয়ে কেউ কেউ খিস্তিখেউড়েও মেতেছেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও এক্তিয়ার নিয়ে, সংবাদ প্রকাশের মোডাস অপারেন্ডি বা করণকৌশল নিয়ে এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার সীমা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন/বলেছেন।  এসব নিয়েও আলোচনা বা সিভিলাইজড ডিবেইট হতেই পারে।  

নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিও কিন্তু ছিল এক মহা সিক্রেট। কিন্তু সোর্স থেকে খবর পেয়ে মিডিয়া তা ফাঁস করে দ্যায়। এটা তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের মন:পুত হয়নি। তাই বলে কেউ তো বলেনি যে, খবরটি ছিল ভুয়া। এর মানে মিডিয়া সবাইকে খুশি করতে পারবে বা করবে---ব্যাপারটা এমনও নয়।  

বাবুল আক্তারের বিষয়ে যারা মিডিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছেন তাদের সব প্রশ্নের চমৎকার জবাব তুলে ধরেছেন এদেশে নবধারার সাংবাদিকতার সূচনাকারী সাংবাদিক নাইমুল ইসলাম খান। রোববার রাতে বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল যমুনা টিভির টকশো ‘২৪ ঘণ্টা’য় তিনি এ নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন। এসপি বাবুল আক্তারকে নিয়ে অনলাইন মিডিয়ার ভূমিকাকে তিনি সঠিক বলেই দাবি করেছেন। তিনি তার অবস্থানের পক্ষে জোরালো যুক্তিও তুলে ধরেছেন। সোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত হাইপার সেনসিটিভ বা অতি স্পর্শকাতর সংবাদ প্রকাশের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়েও কথা বলেছেন।  

এবার আসুন দেখি নাইমুল ইসলাম খান কি বলেছেন রোববার রাতে টকশো-তে। সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে এক জায়গায় তিনি বলেছেন: ‘‘...দায়িত্বশীল মানুষেরা যখন নিজের নাম গোপন রেখে আমাকে কিছু একটা বলেন, সাংবাদিক হিসেবে তখন আমরা কি করবো? তখন আমরা ঝুঁকি নেই। সাংবাদিকতা একটা ঝুঁকি। আর এই ঝুঁকির জন্য মাঝে মধ্যে আমরা হয়তো ভুল করে ফেলি। হয়তো আমার সোর্সই আমাকে বিভ্রান্ত করলো। সারা দুনিয়াতেই এমনটা ঘটে। সাংবাদিক প্রায়শ্চিত্ত করে। কারণ সে তার সোর্সের মিথ্যা তথ্যের জন্য বিপদগ্রস্ত হলো। আবার এমন হয় সোর্স নিজেই বিভ্রান্ত হয়েছে। হয়তো তার সোর্স তাকে বিভ্রান্ত করেছে। ’’ 

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন: ‘‘আমি গতকাল একজন সোর্সের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি আমাকে একটা তথ্য দিয়েছেন। আমি হয়তো রিপোর্ট করছি না। কারণ আমি রিপোর্টার না। কিন্তু জানছি। আবার আমার রিপোর্টার জানতে পারলে সেটা (নিয়ে) রিপোর্ট করতো। সাংবাদিকের দায়িত্ব একটাই, আর কিছুই নয়। ’’

অনেকে প্রকাশিত সংবাদকে গালগল্প বলে উপহাস করবার সহজ ও সস্তা পথ ধরেছেন। উল্টো তারাই আবার চান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। তারাই চান অজানা তথ্য ও সত্য। তারাই আবার মনপসন্দ না হওয়া সংবাদকে ‘‘নিছক গালগল্প’’ বলে উড়িয়ে দিয়ে এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। এই দ্বিমুখি অবস্থানটাও কাম্য নয়। মনপসন্দ নয় বলে সংবাদকে যারা গালগল্প বলে উড়িয়ে দিতে চান তাদের উদ্দেশে নাইমুল ইসলাম খান বলেন: 
‘‘আমরা আসলে গল্পই ছাপি এবং সেটাকে স্টোরি বলি। আপনি যদি আমাকে বলেন, স্টোরিটা কি এ রকম গল্প ছাপানো উচিত? আমার মনে হয়, ছাপানো উচিত। যদি একজন ব্যক্তি বলতে পারেন তাহলে কেন ছাপাবো না। তথ্য সঠিক, তাই আমরা তথ্যটা ছাপছি না। আমরা ছাপছি কারণ একজন বিশিষ্ট বা দায়িত্বশীল ব্যক্তি এটা বলছেন। ’’

আমি যদি জানি, আপনাকে তা জানাতে দোষ কি! সমুদ্রে ডুবে মরা আয়লান কুর্দি নামের সিরীয় শরণার্থী শিশুর ছবি ছাপানো সাংবাদিকতার নীতিবিরোধী বলবেন/বলেছিলেন অনেকে। কিন্তু পশ্চিমের উন্নত মিডিয়া কিন্তু তাই বলে বসে থাকেনি হাত গুটিয়ে। ইরাকের আবু গারাইব কারাগারে মার্কিন বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের ফুটেজ প্রকাশ ঠিক ছিল কি? এক কথায় কি এর জবাব? এসব ছবি পেয়েও না ছাপলে কার লাভ বেশি হতো? 

নাইমুল ইসলাম খান নিজেকে সরাসরি সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করেই আয়লান কুর্দির লাশের ছবি প্রকাশের পক্ষে অবস্থান নেন টকশোতে।  
সংবাদ ছাপানোর মধ্যে দোষ না খুঁজে বরং ওই রাতে (মধ্যরাতে) একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে যে পন্থায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো এবং পরে যা যা করা হলো তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন:

‘‘এসপির মতো সিনিয়র পজিশনের (তার ভাষায়, পুলিশের মহাপরিদর্শকের মাত্র কয়েক ধাপ নিচের) একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে মধ্যরাতে ডেকে, টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে তাকে ১৪/১৫ ঘণ্টা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখবেন? তার বাসায় কোনো খবর পর্যন্ত দিতে দেবেন না? তারপর আপনারা অন্য কিছু বলবেন, আই অ্যাম দ্য লাস্ট পারসন টু একসেপ্ট দ্যাট। ’’ 

‘‘ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর শ্বশুরকে কেন বাবুল আক্তার একটা টেলিফোন করে বলেননি আমি ভালো আছি। ..এসপি সাহেব এখন অফিসে যান না, আবার ছুটিতেও না। তার বাসার সামনে ফোর্স রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন? সেটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। ’’

নাঈমুল ইসলাম খান টক-শোতে অনলাইনে বাবুল আক্তারের স্ত্রী সংক্রান্ত খবর প্রকাশ প্রসঙ্গে যা বলেছেন সেদিকেও সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই : ‘‘ একজন পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকে জড়িয়ে এ রকম তথ্য পরিবেশ করা হলো। অথচ কাউকে তো সুস্পষ্ট করে বলতে শোনা গেল না যে, তার স্ত্রীকে জড়িয়ে যে তথ্যটা পরিবেশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি আরও বলেন, অনলাইন পোর্টালে বাবুল আক্তার ও তার স্ত্রীকে জড়িয়ে করা সংবাদ সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, হতেও পারে। ’’

নাইমুল ইসলাম খানের যুক্তি যাদের মন:পুত নয় তারা চাইলে পাল্টা এবং অধিকতর জোরালো যুক্তি তুলে ধরতেই পারেন। সত্য অপ্রিয় হলেও সত্য। সংবাদমাত্রই মনপসন্দ সংবাদ নয়। আমরা যেন একথা ভুলে না যাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৬
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।