ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মিডিয়াকে দুষবেন না

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৬
মিডিয়াকে দুষবেন না

আজকের সমাজে মানুষ আর তথ্য ভারাক্রান্ত খবর চায় না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কি সিদ্ধান্ত হলো তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই।

তাদের আগ্রহ ‘যোগাযোগমন্ত্রী বাসের টিকিট কেটে সচিবালয়ে গেলেন’, কিংবা ‘অর্থমন্ত্রী বললেন, অল রাবিশ’ এসব শিরোনামের খবরে।

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের ইস্যুতেও তাদের আগ্রহ ছড়িয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিতে কারা নোবেল পুরস্কার পেলেন তার চেয়ে বেশি তারা আগ্রহ দেখান সাবেক মিস ইউনিভার্সকে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প মোটা কিংবা মিস পিগি বলেছেন তা নিয়ে প্রকাশিত খবরে। কিম কারদাশিয়ানকে বন্দুকের মুখে ডাকাতি করে মিলিয়ন ডলারের অলংকার নিয়ে গেছে, কিংবা ধর্ষিত হতে বসেছিলেন কিম সে খবরেই তাদের উৎসাহ বেশি।

সন্দেহ নেই মানুষ খবর জানতে চায়। তবে কোন খবরে বেশি আগ্রহ সেটা দেখতে হবে। পাশাপাশি তাদের খবরের আউটলেটটি কি হবে সে নিয়েও রয়েছে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়।

এখন স্পষ্ট করেই বলা চলে সংবাদপত্রে আগ্রহ হারিয়েছেন অনেকেই। ফলে সংবাদপত্র এখন মৃত্যুদশায়। পাঠক পক্ষান্তরে অনলাইনে খবর পড়তে আগ্রহী। এই আগ্রহ বেশি দিনের পুরোনো নয়। তবে অল্পতেই ফুলে ফেঁপে বড় হয়েছে এই সংবাদমাধ্যম। এইতো সেদিনও যাকে ফিউচার মিডিয়া ভাবা হতো, তা এখন পুরোদস্তুর নিউ মিডিয়া। আরও একটু এগিয়ে বললে মিডিয়া বলতে এখন প্রথমেই অনলাইনের কথা ভাবা হচ্ছে।

এখন ঘটে যাওয়া খবর এখনই প্রকাশ করে অনলাইন। আর পাঠক যখন তা পড়েন আর বলেন, খবরটি মিডিয়ায় এসেছে। তখন তিনি অনলাইনকেই বোঝাতে চান।

সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ অন্যান্য সনাতনী মিডিয়ার একটা সমস্যা বরাবরই ছিলো। তা হচ্ছে স্থান সংকট। সব খবর দেওয়ার সুযোগ তাদের ছিলো না, নেইও। ফলে তাদের যখন খবর বাছাই করতে হয়, তখন অনেক বেশি জার্নালিস্টিক হতে হয়। আর তখন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবরটির সঙ্গে যোগাযোগমন্ত্রীর বাসে ভ্রমণের খবরটির লড়াই বেধে যায়। আর ‘জার্নালিস্টিক’ হতে সংবাদপত্রে গুরুত্ব পায় মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি।

এই সংকটটি অনলাইনে নেই। এখানে বিশাল ক্যানভাস। অফুরন্ত। ফলে দ্রুতই সিদ্ধান্ত হয়ে যায়, দুটো খবরই প্রকাশিত হবে। এরপর শুরু হয় পাঠকের পালা। তারা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের খবর অপাংক্তেয় ফেলে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন মন্ত্রীর টিকিট কেটে বাসে চড়ার খবরের ওপর। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে তা ভাইরাল হয়ে ছড়াতে থাকে।  

সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে দেওয়া বক্তৃতার চেয়ে তারা বেশি পছন্দ করতে থাকেন, ওয়াশিংটনে ছেলের বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর ছুটি কাটানোর খবর।

সুতরাং বলাই চলে, মানুষ খবর জানতে চান কিন্তু তার মাধ্যম যেমন পাল্টেছে, পাল্টে গেছে তার ধরনও।

খবরের জন্য অনলাইনকে বেছে নেওয়ার পর এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে অনলাইনে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন নাকি সামাজিক মাধ্যমে ঝুঁকে পড়েছেন।

তবে এই প্রশ্নটি এখন অনেকটা অবান্তর হয়ে পড়েছে, কারণ কে না জানে সামাজিক মাধ্যমেই ঝোঁক সবচেয়ে বেশি মানুষের। ফেসবুক, টুইটারেরই এখন জয়জয়কার।

ফলে এবার বিপাকে অনলাইন সংবাদমাধ্যমও। সাংবাদিকতার সকল শর্ত মেনে, মান বজায় রেখে যে খবর অনলাইন প্রকাশ করছে তার প্রতি পাঠকের যতটা না ঝোঁক তার চেয়ে তারা পড়ে থাকতে পছন্দ করে টুইটার কিংবা ফেসবুকে দেওয়া দুই বাক্যের একটি ছোট্ট পোস্টে। সেখানেই থাকে লাইক-রিঅ্যাক্টের ছড়াছড়ি। মোবাইল ডিভাইসে এই দুইবাক্যের টুইটার ফিড কিংবা ফেসবুক পোস্ট অাধিপত্য বিস্তার করে থাকে। তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন পাঠক।

তাহলে এও হয়েছে, পাঠক সন্তুষ্টির দিক-মাত্রাও পাল্টেছে। একটি পূর্ণাঙ্গ খবর পড়তে তাদের যে আকুতি ছিলো। সাংবাদিকতার কাঠামোয় ফেলে খবরকে সাজানোর যে প্রয়োজন ছিলো তা এখন কমে যাচ্ছে। দুই বাক্যের খবরেই যখন পূর্ণ সন্তুষ্টি, আর তা যখন ফিড কিংবা পোস্টে মিলে যাচ্ছে তখন আর কেই খোঁজে, কোন অনলাইন সংবাদপত্র তা প্রকাশ করেছে কি করেনি?

হ্যাঁ খোঁজে- সে খবরটি যদি হয় ‘৪৫ কেজিই থাকে নুসরাত ফারিয়ার ওজন’ কিংবা ‘ব্র্যাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জলির বিচ্ছেদ’ শিরোনামে।

বিশ্বাস করুন, সেখানে কিন্তু আরও অনেক ভালো ভালো খবর থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে তা অনেকেই পড়তে চান না।

এতে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ বাড়ে। পাঠক কি পছন্দ করে সেই খবর বেছে বেছে খুঁজতে হয় তাদের। কত গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া যায়। কোনও কোনও অনুসন্ধানী রিপোর্টার বড় বড় দুর্নীতির খবর বের করে আনেন, তারা শিক্ষার মানের অবনতির কথা লেখেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করা হচ্ছে, দশ টাকা দরের চাল বিতরণে অনিয়ম চলছে তার খবর সাক্ষ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরেন। কিন্তু পাঠক রা কাড়েন না। তারা আগ্রহ নিয়ে পড়েন, ভাইরাল করে ছড়ান ‘নুসরাত ফারিয়ার ওজন?’ গোছের খবর।

অনলাইনে সংবাদকর্মীদের যতটা দ্রুত সম্ভব খবর দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়। ডেডলাইনের মধ্যে খবর না দিতে পারলে পিছিয়ে পড়তে হয়। সনাতনী পদ্ধতিতে একজন রিপোর্টার একটি খবর তৈরির জন্য অন্তত একটি দিন সময় পান। তাতে তথ্য পেলে তার সত্যাসত্য যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর সাংবাদিকতার কাছে এই যাচাই-বাছাই কথাটি স্রেফ অতীতের বিষয় হয়ে উঠেছে।

‘অন্তত তিনটি সূত্র থেকে খবরের সত্যতা যাচাই করতে হবে’ বলে যে তত্ত্ব সাংবাদিকতার নৈতিকতায় উল্লেখ করা হয়েছে আজকালকার খবরে তা অবর্তমান। অপ্রয়োগযোগ্যও বটে।

‘সূত্র’ সাংবাদিকতার একটি বড় বিষয়। ভালো সূত্র থেকে খবর বের করে আনতে পারাটা সাংবাদিকের অন্যতম গুণ। কিন্তু এই ‘ভালো সূত্র’র আজ চরম অভাব। সরাসরি তথ্য না দিতে চাওয়াটাও এক ধরনের প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেস কনফারেন্সেও যথা প্রশ্নের তথা উত্তর মেলে না। ফলে মূলধারার সাংবাদিকতা পড়ে থাকে বিপাকে।

ওদিকে ফেসবুক টুইটারে পোস্ট-ফিডে চলে আসে টুইস্টেড খবর। যাদের যাচাই করার বাধ্যবাধকতা নেই। প্রশ্ন করে জানার প্রয়োজনটিও নেই। স্রেফ দুই লাইন তুলে দেওয়া। অনলাইন যখন যাচাইয়ে ব্যস্ত তখন পাঠক ঝাঁপিয়ে পড়ে এই দুই লাইনের পোস্টে। এই খবর কে দিলো? কোথা থেকে এলো? কতটা সঠিক? তা নিয়ে নেই সামান্য মাথাব্যথা।

সামাজিক মিডিয়ার এই আচরণ নিয়ে সরকারের কিংবা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নেই কোনও আগ্রহ। তাদের চোখ পড়ে থাকে মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের ওপর। যেসব কনটেন্ট প্রকাশ করে সামাজিক মাধ্যম পার পেয়ে যাচ্ছে তার ছিটেফোঁটাও মূলধারার সংবাদমাধ্যম করতে পারছে না। ফলে সেখানেও একটা চাপ থেকে যাচ্ছে।

সত্যি কথা বলতে কি, এতে আশঙ্কাই বাড়ছে। পাঠকের এই প্রবণতা মূল ধারার মিডিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বৈকি! আমাদের জবাবদিহিতার কোনও জায়গা যেমন থাকবে না। তেমনি জবাবদিহিতা চাওয়ার ক্ষেত্রটিও হয়ে উঠবে অনুপস্থিত।

সরকারি বৈঠকগুলোর খবর যখন জনপ্রিয়তা হারাবে তখন তাতে সংবাদমাধ্যম কতদিন গুরুত্ব দিতে পারবে সেটা ভাবনার বিষয়। বক্তৃতায় নেতা কি বললেন তা নিয়ে যখন পাঠক অনাগ্রহ দেখাবে তখন সংবাদমাধ্যমের ম্যানেজমেন্ট সে খবর সংগ্রহের জন্য রিপোর্টার পাঠাবেন কি না সেটাও প্রশ্ন। আর তখন কি হবে? ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে- এসবের কোনও কিছুতেই কেউ কিছু মনে করবে না।

সমস্যা হচ্ছে- এমন সব ঘটে যাচ্ছে তবে দোষটা গিয়ে পড়ছে মিডিয়ারই গায়ে।

মিডিয়াকে অপছন্দ করার মানুষ এখন অনেক বেশি। একটা সময় মিডিয়া যেমন সবার আস্থার ও ভরসার একটি স্থান হয়েছিলো-এর স্রোতের তালে চলতে গিয়ে মিডিয়া তার সেই স্থানটি যে হারিয়েছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই।

আমরা তো তাই প্রকাশ করবো যা পাঠক পছন্দ করবে। পাঠকই ত্রাতা। তারাই সংবাদপত্র কেনেন, ওয়েবসাইট ভিজিট করেন, টেলিভিশন দেখেন, রেডিও শোনেন।

আর যারা এদের বিজ্ঞাপন দেন তারা ক্রেতা, পাঠক, দর্শক, শ্রোতার ভিত্তিতেই বাছাই করেন। যার পাঠক যত বেশি। কিংবা যার হিট বেশি, যার টিআরপি সর্বোচ্চ সেটাই বিবেচ্য। অর্থতো তারা সেখানেই বেশি ঢালবেন। আর এই বিজ্ঞাপনের অর্থেই সংবাদকর্মী, সম্পাদকের বেতন আসে।

তাহলে আমাদের কাজটি টিকিয়ে রাখতে কিংবা জীবনে ধারণের জন্যই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে পাঠককে সন্তুষ্ট রাখা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পাঠকই আবার মিডিয়াকে দুষছেন।

তাহলে সময় এসেছে পাঠককে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে, কোন ধরনের খবর আজ আমি পড়বো? কোন আর্টিকেলটিতে ক্লিক করবো। কোনটি আমিও শেয়ার করবো আমার ফেসবুক কিংবা টুইটারে।

কারণ পাঠকের চাহিদা মতেই তৈরি হবে নতুন নতুন নিউজ স্টোরি। মিডিয়া তাই দেবে যা পাঠকের পছন্দ।

বিশ্লেষক-বোদ্ধারা অবশ্য আরেকটি কথা বলেন, যা প্রণিধানযোগ্য। ‘পাঠককে যোগ্য করে তোলাও মিডিয়ারই দায়িত্ব’।

বাংলাদেশ সময় ১২২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৬
এমএমকে/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।