ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’ ।। নিনি ওয়াহেদ 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১০ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৭
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’ ।। নিনি ওয়াহেদ  নিনি ওয়াহেদ

সমুদ্রযাত্রা! শব্দটির মধ্যে এক ধরনের ব্যঞ্জনা মিশ্রিত। সহজ আকর্ষণ বিকর্ষণের সম্ভাবনাকেও নাকচ করা যায় না। প্রাথমিকভাবে না হলেও শেষমেশ জাহাজে উঠে পরা।

যেভাবেই বলি না কেন- আকর্ষণের প্রতি পাল্লাভারী বলে প্রতীয়মান। ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখ, বেলা তিনটা চল্লিশ মিনিট, জাহাজের চুল্লি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া চিরচেনা বাংলাদেশের জাহাজ ছাড়ার ভোঁ ভোঁ আওয়াজ যেন কানে বেজে উঠে।

হালকা মেজাজে জাহাজের দোলন- যাতে মনে হয় দ্রুত লয়ে নৃত্য শুরুর পূর্ব মুহূর্তে মৃদু পায়ের কাজ করছে কোন দক্ষ শিল্পী, আর তাতেই দুলে দুলে উঠছে বিশাল জাহাজ, দৌড়ে যাই ডেকে। ম্যানহাটনের পিয়ার থেকে জাহাজের যাত্রা।  

সুউচ্চ ভবনের দৃশ্যাবলী থেকে কিছুটা সরে আসতেই চোখে পরে এলিস আইল্যান্ড যেখান দিয়ে ১৮৯২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এসেছে আমেরিকার অভিবাসন গ্রহণের জন্য। কত বেদনা কত যন্ত্রণা আর কত আশাভঙ্গের ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে আইল্যান্ডটি। ব্যথায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। চলে আসি স্ট্যাচু অব লিবার্টির সীমানার কাছাকাছি, মেঘলা আকাশে অস্ত রবির দেখা না মিললেও ঘনিয়ে আসা আঁধারের আগমনে দূর থেকেই তাকে দেখি। মনটায় এক ধরনের সাহসী অনুভূতির জন্ম হয়, মনে হয় মুক্তির মন্দিরে আমিও একজন।  

অন্ধকার যেন ঘন নিকষ হয়ে ধরা পড়ে। শোনা যায় ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর। স্বাগত জানান যাত্রীদের। সেই সঙ্গে নির্ধারিত কক্ষ প্রাপ্তির ঘোষণা। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে সাতদিনের সমুদ্র যাত্রার নির্ধারিত কক্ষটি পাবার জন্য। ছুটলাম সমুদ্রযাত্রার অস্থায়ী নিবাসে। পরিপাটি করে সাজানো কক্ষটি সহজেই মনে সতেজতা এনে দেয়। জাহাজে প্রবেশ পথে ল্যাগেজ ড্রপ অফ করে এসেছিলাম পৌঁছে দেবে কক্ষে বলে। এখনও আসেনি।  

সময় মিলতেই গেলাম কক্ষের বাইরের ব্যালকণিতে। এতক্ষণে অন্ধকার চেপে ধরেছে চারিদিক। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর হাওয়ার মৃদু সমীরণ ছাড়া কিছুই দেখার আর বোঝার উপায় নেই। তারপরও আঁধার ঘেরা জলরাশির তরঙ্গধ্বনি শুনতে কার মন না চায়-এ এক অসাধারণ মুহূর্ত। ভাললাগা এসে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।  

আবারও ঘোষণা খেতে যাবার এবং জাাহজের নিয়মনীতি সম্পর্কে জানান দেয়া। ল্যাগেজ এসে পৌঁছে গেছে দোড়গোড়ায় আমার যাত্রা সঙ্গী, বলতে হয় যার কন্যারতন আন্নাফী ওয়াহেদ ডোনা, যার বদৌলতে এই সমুদ্র যাত্রা, সেই বোন ডেইজী। ল্যাগেজ পেয়ে দ্রুত কাপড় বদলে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ি ষোলতলা জাহাজের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে। সাত দিনের যাত্রা নিবাসের সাথে সম্যক পরিচয়ের পর খেতে যাই পনেরো তলার ডেকে। অজস্র খাবার, কী খাবার চাই, সকল মহাদেশের খাবারের বিপুল সমারোহ। শুধুই পছন্দের অপেক্ষা। সত্যি বলতে এত রকমের ভিন্নতা- এত রকমের ব্যঞ্জনা- এত দেশ, জাতি, বর্ণ গোষ্ঠীর জন্য রসনা জাগানো অঢেল খাবারের ছড়াছড়িতে সামান্য হলেও ধাক্কা খেলাম। মানতেই হবে। এ যে সত্যি। পেট পুরে খেলাম। এটি ম্যানহাটনের কোন রেস্টুরেন্ট নয়- কুইন্সেও নয়। হেলে দুলে ছন্দে ছন্দে চলমান বিশালাকার জাহাজে। আনন্দের সীমারেখা লংঘন।  

নরওয়েজিয়ান ক্রুজ লাইন এর এটি একটি জাহাজ। নাম নরওয়েজিয়ান ব্রেকওয়ে। জাহাজটি ষোলতলা। যাত্রী সংখ্যা সাড়ে চার হাজারেরও বেশি। ক্যাপ্টেনসহ ক্রু সংখ্যা এক হাজার ছয় শরও বেশি। যাত্রী সেবায় সদা প্রস্তুত। জাহাজ বললে যথার্থ হবে না। ছবির মত সাজানো ছিমছাম একটি ছোট্ট শহর। শহুরে জীবনের সকল অনুসঙ্গই রয়েছে এখানে। শিশুকিশোর থেকে শুরু করে বয়স্ক প্রতিটি মানুষের মন মেজাজের সাথে সঙ্গতি রেখে আনন্দদানের ব্যবস্থাগুলো এত নিখুঁত, এত সুন্দর, এত ভিন্নতার সন্ধিক্ষণে যেন সকলেই একীভূত।  

যাত্রীদের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ, আনন্দময় করে তুলতে জাহাজ কর্তৃপক্ষ থেকেছে সদা সচেষ্ট। প্রতিরাতে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে পরদিনের কর্মযজ্ঞের লম্বা ফিরিস্তি। কোনটি দেখবো আর কোনটি নয় তা নিয়েই হুটোপুটি। দিনব্যাপী বিশাল আনন্দযজ্ঞের আপনার নিমন্ত্রণে কীভাবে সাড়া দেয়া যায়- তা নির্ধারণ ও নির্বাচন করা নিয়েই চলে নিদ্রাবিহীন, রাত্রির কিছুটা সময়। যদি হন নতুন অর্থাৎ প্রথমবারের যাত্রী তবে বুঝে উঠতেই নির্ঘাত সময় ক্ষেপণ হতে বাধ্য শুধু তাই-ই নয়, ভুল নির্বাচনের কারণে আক্ষেপ থেকে যাবার সম্ভাবনা পদে পদে।  

‘ওয়েলকাম এব্রড শো’ দেখে, রাত ৯টার দিকে খাবার পালা শেষে ফিরে এলাম সুসজ্জিত নিজ কক্ষে। হঠাৎ করে ফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় মনের তোলপাড়। মহাসমুদ্রের এই জাহাজে আমি যেন বিচ্ছিন্ন একজন। এ রাতের বোধহয় শেষ নেই- এই জাহাজের গতিপথ শুধুই স্রোতের সাথে এগিয়ে চলা। এর যেমন শুরু নেই শেষও নেই। বিকেলে ডেক এ বসে দেখছিলাম- এই মহাসাগরের নেই কোন কূল-নেই কোন কিনারা। দূরে যত দূরে দৃষ্টি যায় শুধুই জল আর জল। এই জল যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আকাশ নেমে এসেছে যেন এই অতল সমুদ্রের জলরাশির বিপুল হাতছানিতে তারই কোলের মাঝে। এ এক অপরূপ দৃশ্য।  

রাতব্যাপী সমুদ্রের শনশন হাওয়ার আওয়াজ কত সুরে, কত রাগে- কত ভাবে বেজে চলেছে। কোন এক সময়ে ঘুম এসে কেড়ে নেয় আমার সকল ভাবনাকে। আমি ঘুম সাগরে ডুব দেই।  

ভোরের আলোর দেখা না মিললেও বিদায় জানাতে হয় ঘুমকে। আজ সারাদিন-রাত্রি কাটবে সমুদ্রে- এই জাহাজে। কলস্টো ফোবিয়ায় আক্রান্ত আমার অন্তরমনে তোলপাড় শুরু হয় ক্রমান্বয়ে তা জোরদার হতে থাকে। সাগর জলে ভাসমান জাহাজেই আমার সকল গতিবিধি পদচারণা সীমিত। কিছু সময়ের জন্য হলেও আমি বন্দী। কূলহারা জলরাশির বিপুল গর্জনের ওপর ভাসমান এই তরীতে আমি যেন এক দিশেহারা জাহাজ যাত্রী।  

অস্থির মনকে সুস্থির করতে নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে ১৬ তলা জাহাজের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়াই। নিজেকে দেখতে পাই ম্যানহাটনের টাইমস স্কোয়ারে, হাডসন নদী তীরে, কখনো লিংকন সেন্টারে, কখনো বা ব্রডওয়ে শো দেখার থিয়েটার কক্ষে, আবার কখনো বা মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামের এক অংশে, কোন দামী হোটেলের সুইমিং পুলে অথবা ম্যানহাটনের নামীদামী কোন সুশোভিত রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরে। খুঁজে পাই কুইন্সের সায়ন্স মিউজিয়ামে। কনি আইল্যান্ডের শিশু পার্কে ঘুরে আসতেও বাধা নেই।
 
মন চায় বই পড়ায় নিমগ্ন হতে। চলে যাওয়া যায় চমৎকার লাইব্রেরীতে। জাহাজে সমুদ্র ভ্রমণের ওপর যেমন বই আছে তেমনি আছে ওরহান পামুক, আছে সল বেলোর ‘হেন্ডারসন, দি রেইন কিং’। আমাদের সব্যসাচী লেখক সদ্য প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক করেছেন বইটির অসাধারণ অনুবাদ “শ্রাবণ রাজা”। দু কক্ষ বিশিষ্ট ছিমছাম ছোট্ট লাইব্রেরীর র‌্যাকে নওম চোমস্কির বইÑ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচক ইহুদি এই লেখকের বই সেখানে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি বৈকি! সঙ্গে নিয়েছিলাম সৈয়দ শামসুল হকের “তিন পয়সার জ্যোছনা” আর ড. নজরুল ইসলামের “পুঁজিবাদের পর কী” বই দুটো।  

দেড়দিন সমুদ্র জলে ভেসে ভেসে তৃতীয় দিন পৌঁছলাম পোর্ট ক্যানাভেরাল, ফ্লোরিডায়। কী সুশৃঙ্খলভাবে চার হাজারেরও বেশি মানুষের জাহাজ থেকে নামা এবং ফিরে আসার অসাধারণ এক দৃশ্যে ফ্রেমবন্দি হলাম। কোথাও কোন তাড়াহুড়ো নেই- হৈচৈ নেই। ধাক্কাধাক্কি নেই- নেই কোন তর্কাতর্কির কোলাহল। সবাই লাইন ধরে নেমে আসছে, তার আগে জাহাজের ক্রুদের ঘোষণানুযায়ী সবাই থিয়েটার কক্ষে জড়ো হওয়া। তারপর, যার যার পূর্ব নির্ধারিত টিকিট অনুযায়ী ডেকে পাঠানো এবং সকলে বাইরে এলেই দাঁড়িয়ে থাকা গাইডগণ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে যে যেখানে যাবে তাদের ভুল হবার কোন আশংকা থাকে না। আমরা যাবো কেনেডি স্পেস সেন্টারে। তিন বাস ভর্তি করে আমরা ছুটলাম কেনেডি স্পেস সেন্টারের উদ্দেশ্যে।  

আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম পূর্ব নির্ধারিত টিকিট থাকায় সহজেই প্রবেশ ঘটল কেনেডি স্পেস সেন্টারের ভিজিটর কমপ্লেক্স-এ। বিরাট এলাকা জুড়ে এই কমপ্লেক্সে রয়েছে “হিব্রোস এন্ড লিজেন্ডস, রয়েছে বড় বড় রকেট স্থাপন দূরে তৈরি গার্ডেন, আছে নভোচারীর সাথে লাঞ্চের ব্যবস্থা, সাটেল লাঞ্চ অভিজ্ঞতা, টেলিস্কোপ থিয়েটার, ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন গ্যালারীসহ মহাযানের বিভিন্ন দৃশ্যাবলী সম্বলিত ভিডিও- যা নানাভাবে প্রদর্শন করে সকলকে মহাকাশের সাথে নভোযানের সাথে নভোচারীর সাথে একটি মেলবন্ধন তৈরি করে দিচ্ছে।  

ফিরে এলাম জাহাজে। রাত ৯টায় আবার যাত্রা। এবার গন্তব্যে বাহামাস এর “গ্রেট স্টিয়ারআপ কে, আইল্যান্ড। ৭শ’ আইল্যান্ড দিয়ে গঠিত বাহামাস। ৩২টি ড্রিস্টিক্ট এ বিভক্ত করে আইল্যান্ডগুলোকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাহামাস। কিউবার উত্তরে এবং ফ্লোরিডার দক্ষিণ পূর্বে অবস্থান বাহামাস-এর। ১৩ হাজার ৮৭৮ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই আইল্যান্ড। বাহামাস এর রাজধানী নাসাউ। মোট আয়ের শতকরা ৬০ ভাগই আসে পর্যটন থেকে। ভাষা ইংরেজি। জনসংখ্যার বিরাট অংশ আফ্রো বাহামিয়াস। ১ বাহামিয়াস সমান ১ মার্কিন ডলার।  
পরদিন অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর সকাল আটটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বাহামাস-এর গ্রেট স্ট্রিয়ার আপ কে, আইল্যান্ডে। সূর্য ওঠার দুর্লভ মুহূর্ত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারলাম না।  

ধরফড়িয়ে বিছানা ছাড়লাম ভোর ৬টারও আগে। দু’বোনের ব্যালকণিতে গিয়ে দাঁড়ানো, এখনো যায়নি আঁধার। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক ফোকর গলিয়ে আলোর উঁকিঝুঁকি। শীতের দাপট হটিয়ে হিমেল হাওয়ার পরশ, অপ্রকাশিত অনুভূতির মাঝে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ। সমুদ্রের কোলে লুকানো সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে আত্মপ্রকাশের অপরূপ দৃশ্যে বিমোহিত হয়ে ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে থাকা দু’বোনের বোধোদয় হল একটি ঝাঁকুনি খেয়ে জাহাজের থেমে যাওয়ায় যে আমাদের তৈরি হাত হবে আইল্যান্ড যাবার জন্য। সকালের কাঁচা সোনালী রোদে সমুদ্রের গাঢ় নীল জল চোখ জুড়িয়ে দিল। মনে হল আকাশ ভেঙ্গে সব নীল যেন সমুদ্রের জলে এসে মিশেছে। মন গেয়ে ওঠে নিজের অজান্তে-

“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাইনা, 
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না। ” 

সত্যি প্রকৃতির এত সৌন্দর্য এবং রূপ মোহময়তার সৃষ্টি করে। অথচ এই প্রকৃতির ওপরই মানুষের কত অত্যাচার, নিপীড়ন, ক্ষত বিক্ষত করে তোলে। মাঝে মাঝে তাই দেখা যায় তার মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া।
 
মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে পড়া জাহাজে যাত্রীদের উদ্ধারে ছুটে আসছে তিনটি দোতলা ফেরী। দৃশ্যটি এমনই। ছুটছে সবাই ফেরীতে উঠতেÑ কারণ সমুদ্র স্নানের আকুতি সকলের হৃদয় মনে। ফেরী পারাপার দেখতে দেখতে কখন যে মন ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে আমার শৈশবের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা আর পদ্মার স্মৃতি কথায়। ষাটের দশকের শুরুতে যে বুড়িগঙ্গায় বজরা আর সাদাপাল তোলা বিশাল বিশাল নৌকার চলাচল দেখে কেবলি মনে হয়েছে- কোথায় এদের গন্তব্য। কূলহারা নদীর পাড়ে বসে শিশু মনের সেই ছবি আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। দীর্ঘ বিরতির পর এ দেশে গিয়ে প্রেসক্লাব কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণে কন্যাকে নিয়ে নৌবিহারে যাই। বুড়িগঙ্গার করুণ দুর্দশা দেখে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছি, অশ্রুধারায় সিক্ত হতে বাধ্য হই।
 
সারাদিন কাটলো গ্রেট স্টিয়ারআপ কে, আইল্যান্ডে। হাজার হাজার মানুষের নীল জলে সমুদ্র স্নান মনোমুগ্ধকর। আইল্যান্ডের উপকূলে স্পীড বোটে খানিক সময় কাটানো। এই আইল্যান্ডে জনমানুষের কোন বসতি নেই, জাহাজ আসার দিনগুলোতে বিভিন্ন পশরা সাজিয়ে বসে পর্যটকদের জন্য। Norwegian cruise এই আইল্যান্ডটি কিনে নিয়েছে। তাদের যাত্রীদের ব্যক্তিগত আইল্যান্ড হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। এই জাহাজ কোম্পানীর ৮/৯ জন লোক আইল্যান্ডটি দেখভাল করে বলে সেখানে থাকে। রয়েছে আইল্যান্ড জুড়ে অনেক নারকেল গাছ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন চোখ ছুঁয়ে যায়।  

কখন যে রবিঠাকুরের গানের কলিটি আবার গুনগুনিয়ে ওঠে, “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই। ” কেন যে রবীন্দ্রনাথের এই পূজা পর্যায়ের গানটি আমাকে পেয়ে বসে- হ্যাঁ জাহাজ ভ্রমণের বাকী দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত আমি কেবলি শুনেছি নিজ অন্তর মনে এই গানটির সুরধ্বনি। জাহাজ ছেড়ে চলে আসার শেষ ক্ষণ পর্যন্ত। গানটির সুর বেজে চলেছে আমার হৃদয় আকাশে।  

বাহামাস-এর রাজধানী নাসাউর পথে রাতে আবার যাত্রা। নতুন গন্তব্য। শহর বিধায় রয়েছে শান-বাধানো সুদৃশ্য ডকইয়ার্ড। সকাল ৭টার দিকে যথারীতি দু বোনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা। জাহাজটি যখন ধীরলয়ে এসে নাসাউ পৌঁছে শিল্পীর সযতনে আঁকা একটি ছবির মত শহরের প্রতি ছবি যেন মুহূর্তে স্থির হয়ে যায়।  

নাসাউতে “আরডাস্ট্রা জু এন্ড গার্ডেনস” দেখার টিকিট হাতে নীচে নেমেই দেখা পেলাম গাইড এর। শহরটি ঘুরে ঘুরে দেখানোর মধ্যদিয়ে আমাদের ‘গার্ডেনস’-এ যাওয়া। এটি পাখির একটি অনিন্দ্যসুন্দর বাগান। নানা ধরনের পাখির বসবাস। দেখানো হলো পাখির মহড়া, পাখিদের মার্চ পাস্ট ও আমাদের স্যালুট দেয়ার দক্ষতা তারা প্রদর্শন করে আমাদের অভিভূত করে।
 
এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। লোকসংখ্যা ৩৯২,৭১৮। ৯০% মানুষ আফ্রিকান অথবা আফ্রো-বাহামমিয়ান। ইংরেজি প্রধান ভাষা হলেও অনেকে বাহামিয়ান ভাষায় কথা বলেন। প্রতিদিনই কোন না কোন জাহাজ এই সুদৃশ্য শহরে আসে। ফলে পর্যটকদের আগমনে ভরপুর শহরটি বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর পদচারণায় নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। পর্যটন আরও হয় আকাশ ছোঁয়া। সূর্য বালু সাগর এই তিন এর সম্মিলন বাহামাস-এর আইল্যান্ড ও শহরগুলোকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাণভূমিতে পরিণত করেছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যম-িত নাসাউকে বিদায় জানিয়ে জাহাজে ফেরা।  

এবার বাহামাস থেকে দুদিনের সমুদ্র যাত্রা। গন্তব্য- দু’যুগের আমার আবাস নিউইয়র্ক শহর। অর্থাৎ ঘরে ফেরা। রাতের সাগরের রূপ দেখতে ব্যালকনিতে গিয়ে বসার হাতছানি। এদিকটা শীতের প্রভাবমুক্ত বলা চলে। সাগরের বাতাসের মৃদু গর্জন আর হালকা ঠা-ার আবেশ জড়িয়ে দু’বোন বসে রইলাম। কতক্ষণ বসেছিলাম বলতে পারবো না, তবে মনোজগতে স্মৃতির কড়া নাড়ার আওয়াজ যেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মনে পড়ে যায় প্রাণপ্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। সেকালে দীর্ঘ সময় জাহাজে করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন এই মানুষটি। কত গান, কবিতা গল্প, প্রবন্ধ চিঠি এই সমুদ্রযাত্রায় তিনি উপহার দিয়েছেন বাঙালিকে।  

সৃজন বৈভবে তিনি সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছেন বাংলার সাহিত্য ভা-ার। কেন যে মনে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফেরার পথে জাহাজে লেখা কবি গুরুর পত্রের কথা। কৈশোরে পড়া রাশিয়ার বিখ্যাত পত্রের কিছু অংশ। যেন বাঙময় হয়ে ওঠে হৃদয় মিনারে।  

বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির অঙ্গীকারে মানবতাবাদী বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ই ছিল রুশ বিপ্লবের মূল মর্মবাণী। বিপ্লবের কিছু পরেই কবিগুরু যান রুশ দেশ ভ্রমণে। ফিরতি পথে জাহাজে বসেই তিনি পত্র লেখা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে তা শেষ করেন। তাঁর লেখা হুবহু না হলেও এভাবেই মনে পড়ে যায় যে, তিনি লেখেন যে সেখানে না গেলে তার একটা বড় তীর্থ ভ্রমণ অসম্পন্ন থেকে যেতো। রুশ বিপ্লবের ইতিবাচক দিনগুলো যেমন গভীরভাবে তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল, ভাবিয়েছিল ঠিক তেমনি নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সমালোচনা করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিধা করেননি। তিনি লিখেছেন : সোভিয়েট রাশিয়ার মার্কসীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে সর্বসাধারণের বিচারবুদ্ধিকে এর ছাঁচে ঢালবার একটা প্রবল প্রয়াস সুপ্রত্যক্ষ, সেই জেদের মুখে এ সম্বন্ধে স্বাধীন আলোচনার পথ জোর করে অবরুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে এ অপবাদকে আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি- ওদের নির্মাণকার্যের ভিতটা যতো শীঘ্র পাকা করা চাই, এজন্য বলপ্রয়োগ করতে ওদের কোন দ্বিধা নেই। কিন্তু যত জরুরিই হোক, বল জিনিসটা একতরফা জিনিস, ওটাতে ভাঙে, সৃষ্টি করে না।  

কী অসম্ভব এক কঠিন সত্যকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এত গভীরভাবে। উদ্ঘাটন করেছিলেনÑ সেই সময়, যখন মাত্র সংঘটিত হয়েছে রুশ বিপ্লব। ব্যক্তিসত্তার মুক্তির তৃষ্ণা তাঁর লেখনীতে বিরাট স্থান দখল করে আছে। মনুষ্যত্বের মুক্তিতে ছিল তাঁর প্রবল বিশ্বাস। সেই সঙ্গে মনে পড়ে যায় আমার আরেক প্রিয় সাহিত্যিক জার্মানির ইয়োহান ভোলক গাঙ্গ গ্যোয়েটে’র একটি উক্তি। তিনি লিখেছেন, ‘মুক্তিই মানুষের মূল সাধনা এবং সে সাধনার সামনে জাতিতে জাতিতে ভেদের সীমারেখা লোপ পেতে বাধ্য। এসব উক্তি আজ জাহাজ ভ্রমণে আমার সঙ্গী। বিস্ময়ের সাথে স্মরণ করি এসব মহত্তর লেখকদের।  

জাহাজ ভ্রমণের শেষ দুদিনের আয়োজনে নিজেকে সমর্পিত করতে ভোর থেকেই ছুটোছুটি শুরু। দুদিন আগে ব্রডওয়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত মিউজিক্যাল শো “রক অব এজেস দেখি। জাহাজের চার হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন সপ্তম তলার থিয়েটার কক্ষে এটি প্রদর্শিত হয়। সন্ধ্যায় দেখি Cirque Dreams and Jungle Fantasy.” অপর একটি থিয়েটার কক্ষে।  
অসাধারণ নৃত্য ও সঙ্গীতের মুর্ছনায় ‘রক অব এজেস’ দর্শকদের হৃদয় জয় করে নেয়। ‘Cirque Dreams & Jungle Fantasy’ এর চোখ ধাঁধানো পোশাক ও নৃত্যনীতি চমক সৃষ্টি করে দর্শকদের মোহবিষ্ট করে রাখে দীর্ঘক্ষণ। সেই সঙ্গে রহস্যাবৃত জঙ্গলের কাহিনী যেন প্রাণ পায় অভিনয় শৈলী ও আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়। ব্রডওয়ে খ্যাত তারকা ডোনা ভিভিনো’র মনমাতানো সঙ্গীত সন্ধ্যা, লস এঞ্জেলস-এর কমিডি শো, পিয়ানোর অপূর্ব বাদন, গিটারে সুর মুর্ছনা, মুভি “বার্ন দ্যা ফ্লোর’, নতুন প্রজন্মের সঙ্গীত, ফ্যামিলি ক্যারিওকি, পিং পং প্রতিযোগিতা, কেক তৈরির প্রতিযোগিতা, ক্রু ট্যালেন্ট শো, পারফেক্ট দম্পত্তি খেলা, মর্ডান আর্ট সেমিনার, নানান খেলাধূলাসহ অসংখ্য আয়োজন দেখলাম জাহাজ ভ্রমণের দিনগুলোতে। শুধুই মুগ্ধ হওয়া, উপভোগ করা আর সুধারসে সিক্ত হওয়া।
 
নাই দুঃখ, কষ্ট, নাই বেদনা-যন্ত্রণা নাই ভাবনা-চিন্তা- কেবলি আনন্দ, মহা আনন্দ। যেন বহিছে ভূবণে আনন্দধারা। মনের আকুতি আনন্দধারায় স্নাত হতে। ভেসে ভেসে বেড়াতে। জাগরণে স্বপ্নের দেশে পৌঁছে যাওয়া।
 
এদিকে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে গোটা জাহাজে সাজসাজ রব। সর্বত্র রঙের ছড়াছড়ি। রঙবেরঙের বেলুন, ব্যানার, ফেস্টুন আর আলোক সজ্জায় সজ্জিত জলমলে জাহাজ যেন স্বপ্নপুরীতে পরিণত হয়। চারিদিকে জীবনের জয়গানÑ নতুনকে বরণ করে নেয়ার এক বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস।  

বর্ণাঢ্য এই উৎসব আয়োজনে আমরা দু’বোন অংশীদার হয়ে মেতে উঠি আগামীকে বরণ করে নিতে। জীবনের কত ছবি এঁকে চলি। যেন এর শুরু নেই, শেষও নেই। ঘড়ির কাঁটা বারোটার কাছাকাছি পৌঁছাতেই শুরু হয় কাউন্টডাউন। রাত বারোটা বাজতেই আনন্দের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে যেন সকলে ভেসে বেড়াতে থাকে। মহাসমুদ্রের অতল গর্ভে হারিয়ে যায় ২০১৬।  
নতুন বছরের আবাহনে সম্মিলিত কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় স্বাগতম, স্বাগতম, স্বাগতম ২০১৭।  

গত রাতের রেশ নিয়েই শুরু হয় নতুন বছরের প্রথম সকাল। সকলের চোখে মুখে চির নতুনের ডাক। নতুন সবসময়ই স্বপ্ন জাগানিয়া আশা জাগানিয়া। দু চোখ ভরে, হৃদয় জুড়ে স্বপ্নের মায়াজাল বুনে বছরের দ্বিতীয় দিন জাহাজ থেকে আপন গৃহে ফিরে আসা। জাহাজ ছেড়ে এলেও জাহাজের স্মৃতি সঙ্গে সঙ্গে ফিরবে- মাসব্যাপী। থাকবে বছরব্যাপী।  

বাংলাদেশ সময় ১০৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৭
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।