ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাঠ্যবই দিয়ে শুরু, শেষ কোথায়?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪২ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৭
পাঠ্যবই দিয়ে শুরু, শেষ কোথায়?

দেশ নিয়ে যদি কখনো আমার মন খারাপ হয় তখন আমি আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের কথা ভাবি এবং অবধারিতভাবে আমার মনটা ভালো হয়ে যায়। এই দেশে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ের সংখ্যা প্রায় চার কোটি, দেশের জনসংখ্যা চার কোটি থেকে বেশি এরকম দেশের সংখ্যাই এই পৃথিবীতে একেবারে হাতে গোনা।

আমাদের দেশে প্রাইমারিতে যত ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে ইউরোপে অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা তার থেকে কম। এই দেশে শুধু যে অনেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে তা-ই নয়, ছেলে এবং মেয়ে সমানভাবে লেখাপড়া করছে।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে মালালা নামে একটি বালিকা লেখাপড়া করতে চেয়েছিল বলে তার মাথায় গুলি করে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে নিচু ক্লাসগুলোতে অনেক সময় ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি, তারা লেখাপড়াতেও অনেক সময় ভালো রেজাল্ট করে। পৃথিবীতে যত সুন্দর দৃশ্য আছে তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে যখন দুটি শিশু বালিকা গলা ধরাধরি করে কথা বলতে বলতে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যায়।

আমরা জানি, আমাদের দেশের লেখাপড়া নিয়ে অনেক সমস্যা। স্কুলগুলোতে যথেষ্ট শিক্ষক নেই, যারা আছেন তারাও যে সবসময় পড়াতে পারেন তা নয়। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়। বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের কোচিং সেন্টারে পাঠিয়ে তাদের শৈশব থেকে সব আনন্দ কেড়ে নেন। ছেলেমেয়েরা বইয়ের ভারে কুঁজো হয়ে যায়, তারপরও তাদের গাইড বই মুখস্থ করতে হয়। পাঠ্যবইগুলোর মান ভালো নয়, নানারকম ভুলভ্রান্তি হাতে নিলে বোঝা যায় পুরো কাজটি করা হয়েছে এক ধরনের অবহেলা নিয়ে।

কিন্তু এত কিছুর পরও আমরা কখনোই হতাশা প্রকাশ করিনি। কারণ আমরা জানি লেখাপড়া নিয়ে এই সমস্যাগুলো একটুখানি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেই সমাধান করে ফেলা যায়। আগে হোক, পরে হোক এই সমস্যাগুলোর সমাধান হবে, আমাদের দেশের চার কোটি ছেলেমেয়ে ঠিক ঠিক লেখাপড়া করবে। তখন আর আমাদের দেশের ভবিষ্যত্ নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা করতে হবে না।

কিন্তু এই প্রথমবার আমরা আতংকে শিউরে উঠেছি। এই প্রথমবার আমরা আবিষ্কার করেছি আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার যে জগিট আছে সেটি এই দেশের মানুষ, শিক্ষাবিদ, অভিভাবক, ছাত্রছাত্রী কিংবা এক কথায় শিক্ষা পরিবার নিয়ন্ত্রণ করে না; এটি একটি অদৃশ্য শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এবারে নিয়ন্ত্রণটি এসেছে পাঠ্যবইয়ের উপর। পাঠ্যবই ছাপানোর সময় ছোটখাট ভুল-ভ্রান্তি অবহেলা নিয়ে আমরা এতোদিন হই-হল্লা করে এসেছি, এখন হঠাত্ করে দেখছি এই ছোটখাট ভুলভ্রান্তি অবহেলা থেকে হাজারগুণ বড় একটি অশুভ ষড়যন্ত্র। আমাদের লেখাপড়ার একেবারে ভিত্তিমূল ধরে টান দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে নিয়ে আমাদের পাঠ্যবইগুলোর পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের আমলে আমরা একেবারে হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করেছি এই দেশে পাঠ্যবইটি কেমন হবে সেই সিদ্ধান্তটি আর এই দেশের শিক্ষাবিদেরা নিচ্ছেন না, সিদ্ধান্তটি নিচ্ছে হেফাজতে ইসলাম।

হেফাজতে ইসলামের কথা বলা হলেই আমার ২০১৩ সালের মে মাসের ৫ তারিখের ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। হেফাজতে ইসলাম ঐ দিনটিতে ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়েছিল। এর পেছনের রাজনীতি কিংবা ষড়যন্ত্র কী ছিল—আমার জানা নেই। ব্যক্তিগতভাবে ওই দিনটিকে আমি একটা অশুভ দিন মনে করি, কারণ ওইদিন ভোর পাঁচটায় আমার কাছে একটা এসএমএস এসেছিল, ইংরেজি অক্ষরে বাংলায় সেখানে আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিল: ‘এই নাস্তিক জাফর ইকবাল, তোদের মৃত্যুর ঘণ্টা বাজছে। হতে পারে আজ রাতই তোদের শেষ রাত। কাল হয়তো তোরা আর পৃথিবীতে থাকতে পারবি না। কারণ এই জমনার শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদিস আল্লামা আহমদ শফির ডাকে সারা বাংলাদশের তৌহিদি জনতা মাঠে নেমে এসেছে। সেইসব তৌহিদি জনতা প্রধানমন্ত্রীসহ তোদের সব ধরে ধরে জবাই করে ছাড়বে। আমার আল্লাহকে নিয়ে, বিশ্বনবীকে নিয়ে, আলীমকে নিয়ে, কোরানের হাফিজদের নিয়ে কটূক্তি করার ভয়ংকর পরিণাম কী তা আগামীকাল হাড়ে হাড়ে টের পাবি তোরা। ’

হেফাজতে ইসলামের প্রকৃত রূপটি এই এসএমএসটি পড়লে বোঝা যায়। আমাদের পাঠ্যবইয়ে এই হেফাজতে ইসলামের ইচ্ছে মেনে নিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম যে অবরোধ তৈরি করেছিল, সেখানে লাখ লাখ পুরুষ মানুষ ছিল, সেখানে কোনো মহিলা ছিল না। আমরা নারী এবং পুরুষকে সব জায়গায় সমানভাবে দেখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি নারী-পুরুষের এই সম্মিলিত শক্তি। হেফাজতে ইসলামের জগতে নারীদের কোনো স্থান নেই। নারীদের অবদান দূরে থাকুক নারীদের অবস্থানটি পর্যন্ত তাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।

এই হেফাজতে ইসলাম ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ে যে পরিবর্তনগুলো আনতে চেয়েছিল, আমরা দেখতে পেয়েছি পাঠ্যবইয়ে হুবহু সেই পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। ঘটনাটি জানতে পেরে এই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, লেখক, কবি-সাহিত্যিক সবাই তীব্র ভাষায় তার প্রতিবাদ করেছেন। তার উত্তরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বক্তব্য রাখা হয়নি। ছোটখাট যে বানান ভুল ছিল, তথ্যের যে বিভ্রান্তি ছিল সেগুলো নিয়ে একটুখানি কথাবার্তা হয়েছে, কিন্তু আদর্শগত যে বিশাল একটা পরিবর্তন সূচনা করা হয়েছে—সেটি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য রাখা হয়নি। আমরা লোকমুখে নানারকম কথা শুনতে পাই, সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে পারি না। শোনা যায়, পাঠ্যবইগুলো বিতরণের জন্য পাঠানোর পর ফিরিয়ে নিয়ে এসে সেগুলো হেফাজতিকরণ করে নতুনভাবে ছাপিয়ে আবার পাঠানো হয়েছে। সত্যি যদি এটি ঘটে থাকে তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষার ইতিহাসে এর থেকে বড় আঘাত আর কখনো আসেনি। সরকার এ ব্যাপারে মুখে তালা দিয়ে বসে আছে, একবারও মুখ খুলছে না। পত্র-পত্রিকায় দেখেছি হেফাজতে ইসলাম এই পাঠ্যবই নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তারা মোটামুটি প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে, পাঠ্যবইয়ের এই পরিবর্তনটি মোটেও শেষ পরিবর্তন নয়। এটি মাত্র শুরু। তারা আরো অনেক রকম পরিবর্তন দাবি করে আসছে, আমরা যেই পরিবর্তনগুলো মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া বাংলাদেশে এর আগে কখনো কল্পনা পর্যন্ত করতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কী, তারা যে দাবিগুলো জানিয়েছে সেটি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় অনেক বড় করে গুরুত্ব দিয়ে ছাপিয়েছে। সেটি পড়ে মনে হয়েছে, সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের দেশটি হঠাত্ করে একটি সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র একটি ভুল করে বিএনপি সবসময় জোরগলায় তার প্রতিবাদ করে। পাঠ্যবইয়ের এই হেফাজতিকরণের পর আমরা কিন্তু তাদের মুখ থেকেও কোনো প্রতিবাদ শুনতে পাইনি।

আমাদের দেশে লেখাপড়ার অনেকগুলো ধারা, কওমি মাদ্রাসা তার একটি। শিক্ষানীতি নিয়ে যখন কাজ করা হয়েছিল তখন কওমি মাদ্রাসাকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারার মাঝে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল, তারা আসতে রাজি হয়নি। এই দেশের মাঝে থেকেও তারা তাদের নিজস্ব লেখাপড়ার একটি ধারাকে বজায় রেখেছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বপ্ন আর লক্ষ্যের সঙ্গে তার মিল নেই। এতোদিন তারা শুধু তাদের নিজেদের লেখাপড়ার বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করেছে, এই প্রথম আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তারা এখন আমাদের দেশের মূলধারার লেখাপড়ার বিষয়বস্তুটি তাদের মতো করে পরিবর্তন করার দাবি করছে। তারা কত কিছুই দাবি করে, এই লেখাটিতে আমি যে এসএমএসটি তুলে দিয়েছি সেখানেও তাদের শুধু দাবি নয়—তাদের পরিকল্পনার কথাও আছে। কিন্তু সেই অযৌক্তিক দাবিগুলো মানতে হবে, সেই কথাটি কে বলেছে?

সরকার তাদের দাবি কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছে। বড় বড় কবি-সাহিত্যিক লেখকদের হিন্দু এবং মুসলমান হিসেবে ভাগ করেছে এবং হিন্দুদের লেখা বাদ দিয়েছে। এটি যে কতো বড় একটি পদস্খলন, সেই কথাটি আমরা কেমন করে বোঝাব? সরকার কি মনে করছে এই কাজকর্মের কারণে পরের নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম তাদেরকে ভোট দিয়ে নির্বাচনে জয়ী করবে? সেটি কখনোই ঘটবে না।

আমার এখন বারবার বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ছে। পাকিস্তান জন্ম হওয়ার কয়েক বছরের ভেতর বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন—একটি দেশ শুধুমাত্র একটি ধর্মের মানুষের জন্যে হতে পারে না। তাই তিনি তার দলের নামটি আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেছিলেন আওয়ামী লীগ। তিনি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন—এই দেশটি আসলে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্যে। আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দলটি বুঝি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আবার আগের সাম্প্রদায়িক রূপটিতে ফিরে যেতে চাইছে। আওয়ামী লীগ সরকারকে বুঝতে হবে, এই দেশের মূল শক্তি কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার মাঝে নয়। এই দেশের মূল শক্তি এই দেশের আধুনিক তরুণ জনগোষ্ঠী। তারা ডিজিটাল বাংলাদেশকে গ্রহণ করে, যুদ্ধাপরাধীর বিচারকে স্বাগত জানায়। তারা একটা আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে চায়। এই আধুনিক তরুণ জনগোষ্ঠীকে অস্বীকার করে হেফাজতে ইসলামকে তুষ্ট করার চেষ্টার মতো বড় ভুল আর কিছু হতে পারে না।

আমরা কিছুতেই আমাদের নতুন প্রজন্মকে শত বছর আগের সাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে বড় করতে চাই না, নতুন পৃথিবীর আধুনিক মানুষ হিসাবে বড় করতে চাই।

লেখক :কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।