ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৭
স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানী হানাদাররা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ তারা বাঙালি নিধনযজ্ঞে পরিচালনা করেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’।  বাঙালি প্রথম আঘাতটি সামলে নিয়ে অতিদ্রুতই প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। 

আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।

একাজে আমাদের প্রবাসী সরকার সচেষ্ট ছিলেন।  

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই একদল বাঙালি নেতা কলকাতায় পৌঁছান। সেখানে গিয়ে তারা প্রবাসী সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। সরকার গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাজউদ্দিন আহমেদ। সেই সাথে নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, কর্নেল এম এ জি ওসমানীও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।  

মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্ব ও দূরদর্শীতায় অতিদ্রুতই একটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এ লক্ষ্যে তিনি কয়েকবার কলকাতা দিল্লি যাওয়া-আসা করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সাথেও তার যোগাযোগ হয়। প্রবাসী সরকারের সদর দপ্তর হয় থিয়েটার রোডের একটি বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুকে প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি ও তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাজউদ্দিন আহমেদ হন প্রথম প্রধানমন্ত্রী।  

প্রবাসী সরকার গঠনের এরকম দৃষ্টান্ত আরো রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালেও ফরাসী সরকার ও জেনারেল দ্য গল এ রকম এরকম  স্থায়ী সরকার গঠন করেন।

মুক্তিযুদ্ধকে একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়া করাতে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এ অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর সরকার পথ গ্রহণ করে। মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথ তলায় এ সরকার শপথ গ্রহণ করে।  

মুক্তিযুদ্ধে ভারত নানাভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এসময় প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে তারা তাদের ভূখন্ডে আশ্রয় দিয়েছে। তারা শুধু আমাদের কূটনৈতিক সহায়তাই দেয়নি, বিশ্বের অপরাপর দেশের সমর্থন লাভের জন্যও তারা জোর চেষ্টা চালিয়েছে।  

ভারত আমাদের প্রবাসী সরকারকে আশ্রয় দিয়েছে। শুধু সরকার নয় ভারতের আপামর জনগণও বাঙালিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বরং ভারত সরকারই জনগণের দাবীর মুখে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে।  

মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে হানাদারদের প্রধান জেনারেল নিয়াজির পিআরও সিদ্দিক সালিক এর বই উইটনেস টু সারেন্ডার বইতে তিনি বলেন যে ভারতে এক লক্ষ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ৩০,০০০ জন সাধারণ প্রথাসিদ্ধ কায়দায় যুদ্ধ করবে ও বাকী ৭০ হজার যুদ্ধ করবে গেরিলা কায়দায়।  

রবার্ট জ্যাকসন তার সাউথ এশিয়ান ক্রাইসিস বইতে লিখেছেন, মে মাসের শুরু থেকেই বাংলাদেশী বাহিনীর দল গঠন, প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্রীকরণ আরম্ভ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলাযুদ্ধ চালাবার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশে সরকারকে প্রচ্ছন্নভাবে সব ধরনের সহযোগিত করা হয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের প্রধান দায়িত্বটি ভারতই পালন করেছিল। সীমান্তের ওপারে নিরাপদে প্রশিক্ষণ শেষে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধে অংশ নিত।  

জে এফ আর জেকব এবং নিয়াজির বইতে এবিষয়ে একই মন্তব্য পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিকও সেই একই ভাষায় প্রশিক্ষণের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।  

ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান জেনারেল জেকব বলেন, জুন ও জুলাই মাসে মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছে মূলত সীমান্ত অঞ্চলে, যেখানে তাদেরকে  সহায়তা করার জন্য ভারতীয় বাহিনী আশেপাশেই ছিল। অর্থাৎ সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে তারা ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। কৌশলগত কারণেই এরকমটি হয়েছে।  

বছরের শেষ ভাগে অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতীয় সৈন্যদের সহায়তার ফলে পাকিস্তান বাহিনী ধীরে ধীরে পায়ের নিচে মাটি হারায়।  

সামরিক উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিানায়ক হিসেবে নিয়োগ পান কর্নেল ওসমানী। এপ্রিলেই তাকে সর্বাধিনায়ক করা হয়। তার নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ বাহিনী গঠন করা হয়। সীমিত সম্পদ ও লোকবল দিয়েই তিনি এ কাজে মনোনিবেশ করেন। অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তার ব্যক্তিগত সমরবিদ্যা কাজে লাগিয়ে তিনি অগ্রসর হন।  

জেনারেল জেকব বলেন, ওসামানীকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। জেকব তাঁর  নিয়মতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসা করেছেন।  

এদিকে ভারতে ব্যাপক পরিমান শরণার্থী প্রবেশ করার ফলে সেখানে এক মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। ভারত সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যায়। সে সময়ে শিবিরগুলোতে বিদ্যমান মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে সংবাদ মাধ্যমে। সেসময়ের দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রগুলোকে সে চিত্র দৃশ্যমান।  

অনেক সাংবাদিক সেদিন ভারতের শিবিরগুলোতে ঘুরে মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে এনেছেন। যা পরবর্তীতে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। তাদের অনেকে আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেই ছবি তুলেছেন, প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।  

লন্ডন সানডে টাইমসের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট নিকোলাস বাংলাদেশের ভেতর ঢুকে স্বচক্ষে এখানকার অবস্থা দেখেছেন। এছাড়া নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ও পরবতীতে কিলিং ফিল্ডস খ্যাত সিডনি শ্যানবার্গ, নিউজউইক এর টনি ক্লিপটন যুদ্ধকালীন বাংলাদেশর ছবি তুলে ও প্রতিবেদন তৈরি করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ওপর যে অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা তুলে ধরেছেন।

এভাবে অনেকেই সেদিন রণাঙ্গনে আমাদের পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন। কেউ অস্ত্র দিয়ে, কেউ কলম দিয়ে, কেউ গান গেয়ে তহবিল ফান্ড তুলে-যার যা আছে তাই নিয়ে, দেশে অথবা বিদেশে। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। সবার অবদানেই আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।