ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রসঙ্গত নবাব ও বস-২, অসঙ্গত আন্দোলন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১৮ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৭
প্রসঙ্গত নবাব ও বস-২, অসঙ্গত আন্দোলন নবাব ও বস-২ সিনেমার পোস্টার

সপ্তাহখানেক ধরে 'মিশা সওদাগর পরিবার'  এবং 'জাজ-শাকিব যৌথ জোট' এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব দেশের রাজনৈতিক আলোচনাকে হটিয়ে সংবাদের উপরের পাতায় উঠে এসেছে। চলচ্চিত্রের এ দু’গ্রুপ অভদ্রজনোচিত ঝগড়ায় লিপ্ত রয়েছে।  

আমরা যারা টিকিট কেটে হলে বসে সিনেমা দেখি, তারা এ বিতণ্ডায় বিরক্ত। সিনেমা শুধু শিল্পী, প্রযোজক, হল মালিকদেরই নয়, দর্শকদের কিছু অধিকারও এর উপর আছে অনুভব করে কিছু বলা দরকার বোধ করছি।



দর্শক টাকা দিয়ে সিনেমাওয়ালাদের কাছে বিনোদন কেনে। তাই সিনেমাওয়ালারা দর্শকদের রুচি-চাহিদা বিবেচনা করে সিনেমা বানাবেন এটাই দাবি। কিন্তু গত ৫-৬ বছরে বাজারে যেসব সিনেমা এসেছে সেগুলোর বেশিরভাগই অরুচিকর, অখাদ্য এবং হজম অযোগ্য। তারপরও আমরা অনেকেই বারবার হলে ফিরে গেছি, সুযোগ বুঝে যে যার মতো ইতিবাচক রিভিউ লিখেছি। কিন্তু দর্শক হিসেবে এর প্রতিদান আমরা পাইনি। কারণ শিল্পীরা যা করার তা করেন নি। পরিচালক যা করার তা করেন নি। তারা এখনো তাদের কাজ বাদ দিয়ে অকাজে সময় ব্যয় করছেন। তারা সংস্কৃতি বাদ দিয়ে অপসাংস্কৃতিক মারামারি-কাজিয়ায় ব্যস্ত।

এই কাজিয়া শিল্পী সমিতির নির্বাচনের পরই উৎপত্তি হয়েছে। শিল্পী সমিতির প্রেসিডেন্ট হবার পর মিশা সওদাগর নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট এর মতো ক্ষমতাবান ভাবছেন কিনা জানি না, তবে তথাকথিত চলচ্চিত্র বাঁচানোর নামে মিশা নবাগত দুই নায়ক জায়েদ খান ও সাইমন কে সাথে নিয়ে যে অপ্রীতিকর আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা দর্শক হিসেবে আমরা নেতিবাচকভাবে দেখছি।

মিশা সওদাগর এর চলচ্চিত্র পরিবার শুক্রবার শাকিব খানকে বহিষ্কার করেছেন কথিত কোন 'সাহেব' এর বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে। কিন্তু বহিষ্কারের আগে তদন্ত কমিটি গঠন, কারণ দর্শানো, সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত এসবের কোন নিয়মনীতি অনুসরণ না করে সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা দিয়ে দিলেন, তিনি বহিষ্কার, নাম না বলা অনেককে বহিষ্কার করেছেন!  বোঝাই যাচ্ছে আন্দোলনকাকারীরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন। নৈতিকতাবোধ হারিয়ে তাদের পদের অপব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত জিঘাংসা চরিতার্থে।

তাঁদের মতে,  শাকিব যে সাহেবের কথা বলেছেন, সে সাহেব হচ্ছেন ঢাকার মেয়র পদে নির্বাচনের ইচ্ছা পোষণকারী ব্যক্তিত্ব, একসময়ের তারকা হিরো ফারুক। সিনিয়র অভিনেতাকে অসম্মান করায় সাকিবকে আজীবন বহিষ্কার করা হলো। কিন্তু এর কিছুদিন আগেই শিল্পী সমিতির নির্বাচনের রাতে জুনিয়র শিল্পী সাইমন,  সিনিয়র শাকিব খানের গায়ে হাত তুলেছেন অভিযোগ আছে। একদিন আগেই মধুমিতা হলের মালিক পরিচিত চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব ইফতেখার আহমদ নওশাদ মিশার লোকদের হাতে প্রহৃত হয়েছেন,  সেসব বিচারে কোন আগ্রহ জনাব সওদাগর দেখাননি। ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়ররা এই সমস্যার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা হয়তো কখন কার হাতে লাঞ্ছিত হন সেই ভয়ে আতঙ্কিত।  

শাকিব খান 'সাহেব'দের সম্পর্কে যা বলেছেন তার সাথে আমরা সাধারণ দর্শক একমত। আজ যারা শিল্পী সমিতির নামে অভিনয় ছেড়ে নেতা হয়েছেন, সদ্য সাম্প্রতিক ক্রান্তিকালে তাদের অবদান আসলেই কী? গত দু চার পাঁচ বছরে তারা হলমুখী একটা সিনেমা বানিয়েছেন কি?  ঢাকার হলগুলোতে তাদের সিনেমা দেখতে বসে ৩০ মিনিট পরেই বেরিয়ে আসতে হয়। বিগত বছরগুলোতে যেসব হিট মুভি দেখেছি, আয়নাবাজি, জিরো ডিগ্রি, মনের মানুষ বা যে নাম বলেন না কেন, এগুলো যারা বানিয়েছে তারা কেউ এই নেতা বা নেতাদের স্রোতের মানুষ নন। এই নেতাদের অবদান কী, এ প্রশ্ন তোলা অসঙ্গত  নয়।

আরেকটা প্রশ্ন,  যৌথ প্রযোজনা বা ভারতীয় সিনেমা নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন তারা বছরে মৌলিক ছবি করেন কয়টা? এদেশে যা দেখি তামিল, তেলেগু, মালায়লাম, হিন্দি সিনেমার কপি পেস্ট। নকল করে সিনেমা বানাতে লজ্জা করে না, কিন্তু সেদেশি সিনেমা এদেশে চলতে আপত্তি কেন?

খুব খেয়াল করে দেখা যায়, কপি করার কোয়ালিটিও এসব পরিচালকের নেই। তারা নকল করে যা বানান সেগুলো খুবই মানহীন, হাস্যকর।

আমরা মনে করি, জাজকে বরং অভিনন্দন জানানো উচিত (আমার লেখা এ জন্যই যে একজন দর্শক হিসেবে জাজের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য মনে করছি)। কেননা বস্তাপচা গল্প,  ঢাকাইয়া অশুদ্ধ সংলাপ, সস্তা মেকআপ, হাস্যকর কস্টিউম, টিনের তলোয়ার দিয়ে মারামারি, বস্তির ছেলেপুলে দিয়ে অভিনয়, এসব সস্তা বিনোদন হতে জাজ আমাদের মুক্তি দিয়েছে। আমরা যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কথা বলি জাজ সেটাও করছে মনে করি। আমাদের সিনেমা নির্মাতারা বর্তমান যুগে 'অচল পয়সা'। তারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অজ্ঞ। টলিউডে যন্ত্রপাতি আছে। ভালো মেকআপ ম্যান আছে। ভাল পরিচালক আছে। যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে আমরাই বরং বেশি শিখতে পারব। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের সাথে জোটবদ্ধ থাকার দায় আমাদেরই বেশি। কারণ আমরা পিছিয়ে। জাজ সেই জায়গায় সেতু হিসেবে কাজ করছে। যৌথ প্রযোজনায় ভালো বাজেটের সিনেমা হয় বলার অপেক্ষা রাখে না।

জাজের কল্যাণে বাংলা সিনেমায় আশিষ বিদ্যার্থীর মতো অভিনেতা অভিনয় করছেন। অভিনয় করছেন ইরফান খানের মতো অভিনেতা। যদিও পুরো ক্রেডিট মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর।   তবু প্রযোজক জাজকেও ক্রেডিট দিতে হয়। ফারুকীর এই সিনেমায় কলাকুশলী প্রায় সবই বাংলাদেশি জেনেছি। ভারতীয় কোন পরিচালক নেই। এটা কি সেজন্য ভারতে চলবে না? চলবে!

আসল কথা হল, উন্নত সাংস্কৃতিক সমাজের হৃদয় উদার হয়। তারা সংকীর্ণতায় ভোগেন না।   সংকীর্ণতায় ভোগে দরিদ্ররা। সংকীর্নতায় ভোগে অযোগ্যরা। তারা যোগ্যতা অর্জন করতে চায় না। প্রতিযোগিতা ভয় পায়। তারা দরজা জানালা বন্ধ করে খাটে বসে নিজেকে রাজা মনে করেন, খাটকে মনে করেন সিংহাসন। কেউ দরজায় টোকা দিলে ভয় পায় এই বুঝি রাজত্ব গেল। আজ যেসব শিল্পী বা পরিচালক যৌথ প্রযোজনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন তারা সেই ভয়টাই পাচ্ছেন।

তাদের উচিৎ যোগ্যতা দিয়ে ভয়কে জয় করা। তাদের স্মরণ করা উচিৎ,  যৌথ প্রযোজনার সিনেমার মধ্য দিয়েই আয়নাবাজী কয়েক কোটি টাকা ব্যবসা করেছে। কিভাবে করেছে? করেছে কোয়ালিটি দিয়ে। যৌথ প্রযোজনা বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের সিনেমা ভাল চলবে, শাকিব খানকে বসিয়ে দিলে জায়েদ খান-সাইমন সুপার হিরো হয়ে যাবেন, ব্যাপারটা এতো সহজ না। দর্শক কোয়ালিটি দেখে, কম্পিটিটর দেখে না। যাদের সিনেমা বাজারে চলে না তারা এসব আন্দোলন করে সময় নষ্ট না করে বরং সে সময়টা মগজের পেছনে ব্যয় করলে ভাল করতেন।

এখন ইন্টারনেটের যুগ। মন চাইলে হাতের কাছে বিদেশি সব মুভি পাওয়া যায়। যেগুলো উচ্চ মানের। ভাল গল্প। সু-অভিনয় আছে। সেগুলো ছেড়ে দর্শক হলে আসবে কিসের লোভে তা যতক্ষণ মাথা খাটিয়ে না বের করবেন ততক্ষণ সিনেমার কোন উন্নতি হবে না। শাকিব খান বা জাজ মাল্টি মিডিয়াকে ঈর্ষা করে মাথা ঠুকে মরে কাজ নেই। সংস্কৃতিতে টিকে থাকতে হবে যোগ্যতা দিয়ে। প্রতিভা দিয়ে ভেলকি দেখাতে হবে। একে মেরে ওকে পিটিয়ে তার সাময়িক অসুবিধা করা যায় ঠিকই, কিন্তু নিজেকে বাজারে বিপণন করা যায় না।

চলচ্চিত্রের উন্নয়ন যৌথ প্রযোজনা ঠেকিয়ে সম্ভব নয়।   দর্শক ভালো সিনেমা চায়, যা তারা এখন জাজের যৌথ প্রযোজনার মুভিগুলোতেই পাচ্ছে। তাই তারা দর্শকদের ফেভারিট লিস্টে আছেন এই মুহুর্তে। যারা এর বিরোধিতা করছেন তারা এসব কাজিয়া না করে ভালো গল্প, ভালো মেকিং নিয়ে আসেন। তা না হলে মানুষ সিনেমা দেখবে না।   ইন্টারনেটের যুগে দর্শকদের বিনোদনের অভাব নাই। কিন্তু এই জায়গাটা আপনাদের রুটি রুজির। কাজিয়া করতে করতে সিনেমা হল ও দর্শক হারালে আপনাদেরই না খেয়ে মরতে হবে। দর্শকদের আখেরে কোন ক্ষতিই হবেনা।

মনোয়ার রুবেল, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০১০ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।