ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ আসলে কি?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭
এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ আসলে কি? মিয়ানমমারে জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ, পুরো গ্রাম গুড়িয়ে দিয়েছে সেনারা।

‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ নামক উপমাটি বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। নানা দেশে এক জাতি কর্তৃক আরেক জাতিকে নিধনের সময় জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের অভিযোগ ওঠে।

ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের নিধনের ঘটনা সকলের জানা। পূর্ব ইউরোপে সার্বদের দ্বারা বসনিয়ানদের নিধনের ঘটনাটিতেও বিশ্ব বিবেক কেঁপে উঠেছিল।

আর এখন মিয়ানমারে চলছে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠি নিধনের নির্মম অধ্যায়।

যদিও আমরা জানি যে, আধুনিক মানুষ ও সমাজ সাধারণত সভ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য আচার-আচরণে অভ্যস্ত। কিন্তু সব সময় এই সাধারণ নিয়মটি দেখা যায় না। বিশেষত সাম্প্রতিক বিশ্বের রাষ্ট্র ও সমাজ পর্যায়ে অযৌক্তিক, অমানবিক, হিংসাত্মক তৎপরতার অনেক নজির দেখা যাচ্ছে। সবল কর্তৃক দুর্বলকে সংহারের বহু নারকীয় ঘটনাও ঘটছে। এ কথাটি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেমন সত্য, সমাজ ও সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও ততোধিক সত্য। যে কারণে দেশে দেশে চলছে জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যাঘুদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠদের চরম ও অকথ্য নিপীড়ন-নিযাতন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদিম মানুষের এমন কিছু প্রবৃত্তি ছিল, যা মানবতা, যুক্তিবোধ ও সভ্যতার সঙ্গে মানানসই ছিল না। ফলে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এসব কুপ্রবণতা মানুষ ত্যাগ করেছে।

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি তাণ্ডব।  এগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে ঘৃণিত কাজ হিসাবে। শক্তির জোরে কোনো মানুষ বা সম্প্রদায়ের বা জাতিগোষ্ঠীর ওপর পাশবিক বর্বরতা বা নৃশংসতা এমনই একটি ঘৃণ্য ও পরিতাজ্য প্রবৃত্তি।

দুঃখের বিষয় হলো, ঘৃণ্য ও পরিতাজ্য বলে বিবেচিত হলেও সবাই সেসব ত্যাগ করতে পারে নি। আধুনিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, পোশাক পরিধান করেও আদিম-বর্বরের মতো আচরণ করছে পৃথিবীর বহু দেশের বহু মানুষ। বিভিন্ন সময়ে এই ঘৃণ্য আচরণের পুনরাবৃত্তিতে পৃথিবীর মাটি লাল হয়েছে। নদীগুলো ভেসে গেছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের মরদেহে। বাতাস ভারী হয়েছে লাশ পচা দুর্গন্ধে।

চলতি সময়ে, এই একবিংশ শতাব্দীর চরম উৎকর্ষের যুগে, এমনই একটি ভয়াবহ নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করছে সারা দুনিয়া। মিয়ানমার সরকার তার দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করার জন্য বেছে নিয়েছে নিধন ও পাশবিক নিযাতনের আদিমতম নির্মম পন্থা। অধিকাংশ রোহিঙ্গা নাগরিক প্রাণ হারাচ্ছেন এবং বাকীরা জীবন রক্ষার্থে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন বাংলাদেশে।

মানুষ ও সম্প্রদায়ের বা জাতিগোষ্ঠীর ওপর কিরূপ আচরণ করা হলে সেটাকে ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ বলা হয়, তা স্পষ্ট ভাষায় সংজ্ঞায়িত করা আছে আন্তর্জাতিক আইনে। এই জঘন্য নিপীড়ন-নির্যাতনকে বলা হয়েছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। কোনো ভূখণ্ডে একটি অভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের জন্য সেখান থেকে অন্য কোনও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে জোরপূর্বক বিতাড়ন করাই হলো ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’। এরূপ অপকর্মের মূলে রয়েছে কোনো একটি অঞ্চলের ইতিহাস মুছে ফেলার অপপ্রয়াস।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বলেছে, কোনো একটি রাষ্ট্র বা সরকার যখন মিশ্রিত জনগোষ্ঠীর আবাসভূমিতে একক জনগোষ্ঠীর শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য জনগোষ্ঠীর মানুষদের হত্যা, নির্যাতন, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিতাড়িত করে এবং এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আদিম বা আধুনিক নির্মম কর্মকাণ্ড চালায়, তখন তা রূপ নেয় ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’-এ। ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ সংক্রান্ত সহিংস কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষদের আলাদা করে ফেলা, প্রতিরোধ বন্ধ করতে পুরুষদের হত্যা বা আটক করা, ভীতি প্রদর্শনের জন্য আগুন লাগানো, নারীদের ধর্ষণ করা, শিশুদের পিতৃত্বহীন করা, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া, আতঙ্ক ও গুজব ছড়ানো ইত্যাদি। তাড়ানোর জন্য কখনও কখনও অন্য জাতিগোষ্ঠীকে এনে লেলিয়ে দেওয়ার মতো অপকর্মও করা হয়।

বসনিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপেৱ বৃহত্তম গণহত্যার পর গণকবরে লাশের স্তূপ।  মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ সরকার সংখ্যালঘিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য লক্ষ্যে প্রাচীন ও আধুনিক নির্মমতার সকল পন্থাই গ্রহণ করেছে। সেখানে গণহত্যা চালানো হচ্ছে। নির্বিচারে মানুষ মারা হচ্ছে। সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, জ্বালাও এবং মারো। গুলিতে না মরলে জবাই করো। মৌন অনুমোদন নয়, প্রকাশ্য ও সরকারি নির্দেশে রোহিঙ্গাদের সকল অধিকার হরণ করে পশু-পাখির মতো আহত-নিহত-নির্যাতন ও নিধন করা হচ্ছে। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করে চালানো হচ্ছে জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ। মেরে সাফ করে এবং তাড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ও বৈধ আবাসস্থল আরাকান থেকে ভাগিয়ে দিয়ে সব কিছু দখল করা হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে নির্যাতন, নিপীড়ন, নিধনের এক রক্তাক্ত ও নৃশংস অধ্যায় রচিত হয়েছে মিয়ানমারে, যার শুরু ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। অতীতের সকল নির্যাতনের চেয়ে এবারের রোহিঙ্গা বিরোধী আক্রমণ সবচেয়ে তীব্র, ঘৃণ্য, প্রাণঘাতী, ভয়াবহ ও মির্মম-নৃশংস।

এমনটিই হচ্ছে ফিলিস্তিনেও। বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের জাতিগতভাবে নিধন করে কিংবা তাড়িয়ে দিয়ে দখল করা হচ্ছে তাদের সকল সম্পদ ও ভূমি। এমনটিই হয়েছে বসনিয়ায়, আফ্রিকায় হুতু ও তুসসি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। মিয়ানমারে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ওপর। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রধান সাবেক আরাকান বা বর্তমান রাখাইন প্রদেশ এখন এমনই জাতিগত নিধন ও নিশ্চিহ্নকরণের তোপে জনশূন্য হয়ে গেছে। মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ রোহিঙ্গাই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বছরের পর বছর থেমে থেমে এমন আগ্রাসনে রোহিঙ্গারা ঘরে ফিরে যেতেও সাহস পাচ্ছে না। তাদের একটি বিপুল অংশ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে।

বাংলাদেশের মতো বিপুল জনসংখ্যা ও স্বল্প সম্পদশালী একটি দেশের জন্য এই বোঝা বেশ কঠিন হলেও বাংলাদেশ মানবিক কারণে শরণার্থীদের আশ্রয় ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করছে।

কূটনৈতিক দক্ষতা ব্যবহার করে এই সংকটের সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের এই ঘৃণ্য ও বর্বর ‘জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ’ প্রচেষ্টা প্রতিরোধে বিশ্ববিবেককেও তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে ।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১০, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।