বাংলাদেশ তার উন্নয়ন অভিযাত্রার গৌরবময় অধ্যায় পার করছে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার বাংলাদেশ’ নির্বাচনী ইশতেহারটি যে এত স্বল্প সময়ে দেদীপ্যমান বাস্তবতা হয়ে ধরা দেবে তা কেইবা ভেবেছিল।
অন্যদিকে উন্নয়ন এজেন্ডায় জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে আবির্ভূত হয়ছে। যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শূন্য রিজার্ভ নিয়ে পথচলা শুরু করে ৭১৯ কোটি টাকার প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছেন, আর আজ তার কন্যার হাত ধরে সে বাজেট এখন ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বৎসরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ যা এশিয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ।
কোভিড পূর্ব সময়কাল পর্যন্ত ৫ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। একদিকে সরকার অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের লক্ষ্যে গ্রহণ করছে নানামুখী উন্নয়ন প্রকল্প, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বৃহৎ উন্নয়ন কর্মসূচির পাশাপাশি একযোগে পরিচালিত হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া দুস্থ, অসহায় এবং ছিন্নমূল মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে নানামুখী কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন ভাবনার অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহায়ণের সঙ্গে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, শিক্ষা, পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত হয়েছে। একটি গৃহ কিভাবে সামগ্রিক পারিবারিক কল্যাণে এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’।
কেউ পিছিয়ে থাকবে না
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লক্ষীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন। তার দেখানো পথেই বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৭ সালের ১৯ মে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সেন্টমার্টিনের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা দেখে তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন।
আওয়ামী লীগ নেতার দান করা জমিতেই শুরু হয় পুনর্বাসন কার্যক্রম। আর ১৯৯৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সমগ্র দেশে শুরু করেন ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’। সর্বশেষ অগ্রগতিসহ ব্যারাক ও একক গৃহে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীভুক্ত ৪ হাজার ৮৩২টি পরিবারের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত ৮ হাজার ১০৬টি পরিবারকেও বাড়ি দেওয়া হয়েছে। তাদের পেশা উপযোগী প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রকল্প স্থান বাছাইসহ ভূমি উন্নয়ন ও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে স্থানীয় জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে উপকারভোগী নির্বাচন এ কার্যক্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য ২০টি ভবনে ৬৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এখানে আরও ৩ হাজার ৭৬৯টি পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১১৯টি ভবন নির্মাণের কার্যক্রম চলমান। খুরুশকুল প্রকল্পটি বিশ্বের একক বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে ইতোমধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অন্যতম উদ্ভাবন হচ্ছে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’। একটি ঘর একটি ছিন্নমূল পরিবারের দারিদ্র্য হ্রাসসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এটি এখন প্রমাণিত। প্রতিটি নিরাপদ গৃহ পরিবারের সবাইকে করে তোলে আস্থাবান, প্রত্যয়ী এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী। মুজিববর্ষে এসে দ্রুততম সময়ে গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে গৃহ প্রদানের মাধ্যমে জাতির পিতা সূচিত গৃহায়ন কর্মসূচিকে তিনি নতুনরূপে উপস্থাপন করেন। জাতির সামনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পকে অধিকতর যুগোপযোগী ও টেকসই করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নতুন ডিজাইনের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
ব্যারাক নির্মাণ কর্মসুচির পাশাপাশি প্রতিটি দুস্থ পরিবারের জন্য ২ শতক জমি দেওয়াসহ দুই কক্ষ বিশিষ্ট বাড়ি, প্রশস্ত বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট নির্মাণের জন্য কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে এ বছরের ২৩ জানুয়ারি তিনি প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারের মালিকানা স্বত্বসহ গৃহ দেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ জুন ৫৩ হাজারের অধিক পরিবারকে অনুরূপভাবে গৃহ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যক পরিবারকে গৃহ দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে আর কোন দেশে সম্ভব হয়নি। সমগ্র বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে এসব গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তারা খাস জমি চিহ্নিতকরণ ও অবৈধ দখল করা জমি উদ্ধার করে গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করছে। এ কাজে কখনোবা তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে জমি উদ্ধার করেছে। এছাড়াও অনগ্রসর ও সমাজে অবহেলিত বিভিন্ন সম্প্রদায়কেও মূলধারায় সংযুক্ত করার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কুষ্ঠ রোগীদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বান্দাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প, পরিবার বিচ্যুত ও সমাজ নিগৃহীত হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য দিনাজপুর সদর উপজেলায় বাঙ্গিবেচা আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলায় হাটিকুমরুল আশ্রয়ণ প্রকল্প, দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর এলাকায় কয়লাখনির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দক্ষিণ পলাশবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্পদায়ের জন্য তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের বিশেষত্ব
১. ভূমিহীন, গৃহহীন, দুর্দশাগ্রস্ত ও ছিন্নমূল পরিবাররের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির ও গৃহের মালিকানা স্বত্ব প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্তদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পুনর্বাসিত পরিবার যেন ভবিষ্যতে মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে না পড়েন সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জমির মালিকানা স্বত্বের রেজিস্টার্ড দলিল/কবুলিয়ত, নামজারি সনদ ও দাখিলাসহ সরেজমিনে দখল হস্তান্তর করা হয়। পুনর্বাসিত পরিবারকে ৩ মাস (মেয়াদ) ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়।
২. সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সামাজিক সুবিধা কর্মসূচির আওতায় মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য কর্মসূচির সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি অগ্রাধিকারসহ বিবেচনা করা হয়।
৩. পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদেরকে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার জন্য ব্যবহারিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
৪. সরকারি বিভিন্ন সংস্থা (যেমন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমবায়, মহিলা ও শিশু অধিদপ্তর, সমাজসেবা বিভাগ) থেকে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়। এছাড়া অন্যান্য সামাজিক সংস্থা এবং এনজিওকেও এসব কর্মসূচির সাথে সম্পৃক্ত করা হয়।
৫. পুনর্বাসিত পরিবারের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয় এবং প্রকল্প স্থানে নিরাপদ পানির জন্য টিউবওয়েলের সংস্থান করা হচ্ছে।
৬. পুনর্বাসিত পরিবারের জন্য কমিউনিটি সেন্টার, প্রার্থনা ঘর ও কবরস্থানসহ পুকুর খনন ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।
৭. পুনর্বাসিত পরিবারের জন্য কমিউনিটি সেন্টার, প্রার্থনা ঘর ও কবরস্থানসহ পুকুর খনন ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রাস্তা নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।
৮. প্রকল্প এলাকায় ফলদ,বনজ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপন করা হচ্ছে এবং কৃষি কাজে গৃহহীনদের উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।
এসডিজি (টেকসই অভীষ্ঠ) অর্জনে গৃহ নির্মাণের ভূমিকা
প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জাতিসংঘের Sustainable Goals এর লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে গৃহায়ন কার্যক্রমের বিশেষ সংযোগ রয়েছে। কেবল গৃহ নির্মাণের ফলে মানুষের জীবনের টেকসই উন্নয়নের নানামুখী লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। গৃহায়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রাপ্তি যেমন সম্পৃক্ত তেমনি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রসমূহেও ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১.৪
২০৩০ সালের মধ্যে সব নারী ও পুরুষ বিশেষ করে দরিদ্র ও অরক্ষিত (সংস্থাপন) জনগোষ্ঠীর অনুকূলে অর্থনৈতিক সম্পদ ও মৌলিক সেবা-সুবিধা, জমি ও অপরাপর সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ক্ষুদ্রঋণসহ আর্থিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে।
মন্তব্য: আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানা রেজিস্ট্রি দানপত্রমূলে সরকার কর্তৃক প্রদান করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভূমিহীন ও গৃহহীন প্রতিবন্ধী, দুঃস্থ, বিধবা, স্বামী নির্যাতিতা, বয়স্ক নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১.৫
দারিদ্র্য ও অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর অভিঘাতসহনশীলতা বিনির্মাণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তদের ঝুঁকি কমিয়ে আনা।
মন্তব্য: চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবজনিত কারণে গৃহহারা ৪ হাজার ৪০৯টি দরিদ্র পরিবারের জন্য কক্সবাজারে খুরুশকুলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এখানে তাদের পুনর্বাসনের জন্য ১৩৯টি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প। ইতোপূর্বে ২০টি ভবনের কাজ সম্পন্নপূর্বক ৬৪০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়াও চাহিদা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায় আরো ৫০টি বহুতল ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২.৩
ভূমি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদ ও উপকরণে নিরাপদ ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে খাদ্য উৎপাদনকারী বিশেষ করে নারী, আদিবাসি জনগোষ্ঠী, পারিবারিক কৃষক, পশুপালনকারী ও অন্যান্যদের আয় ও কৃষিজ উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা। এটি র্অজনের জন্য সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে।
মন্তব্য: যেসব উপাদান দারিদ্রকে জিঁইয়ে রাখে পুষ্টিহীনতা তার মধ্যে অন্যতম। অন্যদিকে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের পুষ্টিমান অনেকটাই নির্ভর করে পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতার গুণগত মানের উপর। পুনর্বাসিত পরিবারসমূহ নতুন ঘরে যেমন পানি ও পয়োনিষ্কাশন সুবিধা পাচ্ছে তেমনি গৃহ আঙিনায় কৃষিজ উৎপাদন কর্মে নিযুক্ত রয়েছে। এছাড়া হাঁস-মুরগি চাষ ও পশুপালন কর্মেও তারা যুক্ত আছে। এজন্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সমবায় ভিত্তিতে প্রকল্প এলাকার পুকুরে মাছ চাষ করা হচ্ছে। পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণের জন্যও প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৩
সব বয়সী সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ।
মন্তব্য: পুনর্বাসিত পরিবারসমূহ ইতোপূর্বে যারা ভাসমান জীবনযাপন করতেন তারা নানা রকম সংক্রামক ব্যাধি যেমন-ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মী ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতেন। এছাড়া সুবিধাবঞ্চিত ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রজনন সংক্রান্ত, মাতৃত্বজনিত, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক অসুস্থতার কারণে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতেন। গৃহায়ণের ফলে তারা বিরূপ এবং প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারছেন। একইভাবে গুরুত্ব না দেওয়া কিছু উষ্ণমণ্ডলীয় রোগ বা neglected tropical diseases (NTD) থেকে তারা মুক্তি পাচ্ছেন সুপেয় পানি, স্যানটিশেন ও পরচ্ছিন্নতা নিশ্চিত হওয়ার কারণে। গৃহে অবস্থানের কারণে শিশুদেরকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এছাড়া প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সেবা প্রদান সহজলভ্য হয়েছে। নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শকরা গৃহ ভিজিট করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীসহ অন্যান্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। একই সাথে অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে নারী ও শিশুরা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছেন। মাতৃমৃত্যু ও শশিু মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যর্কমীর উপস্থিতি একটি গুরুত্বর্পূণ বিষয়। আশ্রয়ণ এলাকাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সময়মতো স্বাস্থ্যর্কমীর উপস্থিতি নিশ্চিত করাও অনেক সহজ হবে। আশা করা যায় যে, এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুও হ্রাস পাবে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৫.ক
অর্থনৈতিক সম্পদ এবং ভূমিসহ সকল প্রকার সম্পত্তির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সেবা, উত্তরাধিকার এবং প্রাকৃতিক সম্পদে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পাদন।
মন্তব্য: এ প্রকল্পে উপকারভোগী প্রতিটি ভূমিহীন পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে জমির মালিকানা রেজিস্ট্রি দলিলমূলে দেওয়া হয়। একই সাথে যৌথ নামে নামপত্তন, খতিয়ান ও দাখিলা দেওয়া হয়ে থাকে। ফলে প্রথাসিদ্ধ আইনি কাঠামোর বাইরে উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের সন্তানদেরও সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ৬.২
পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক স্যানিটেশন স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনরীতির অভিগম্যতা নিশ্চিত করা এবং নারী ও বালিকাসহ অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর চাহিদার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে খোলা জায়গায় মলত্যাগের অবসান ঘটানো।
মন্তব্য: দিনমজুর, ভবঘুরে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পূর্বে মলত্যাগের কোন সুনির্দিষ্ট স্থান ছিল না। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেকে খোলা স্থানেও মলত্যাগ করতেন। বর্তমান প্রকল্পে প্রতিটি গৃহের সংলগ্ন ৪ ফুট দৈর্ঘ্যের ৪ ফুট প্রস্থের টয়লেট আছে এবং গৃহ সংলগ্ন টিউবওয়েল থেকে প্রাপ্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ফলে আশ্রয়ণের সুবধিাভোগীরা নিরাপদ ব্যবস্থাপনায় স্যানিটেশন সেবা পাচ্ছেন। সরকারি সংস্থা এবং এনজিও এর মাধ্যমে গৃহীদের জন্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১০.২
বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা, জাতিসত্তা, নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, উৎস (জন্মস্থান) ধর্ম অথবা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য অবস্থা নির্বিশেষে সকলের ক্ষমতায়ন এবং এদের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির প্রবর্তন।
মন্তব্য: ভূমিহীন এবং গৃহহীন যে কোন বয়সের মানুষই এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। তবে প্রবীণ, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও স্বামী পরিত্যক্তাদের তাদের অসহায়ত্বের বিষয়টি বিবেচনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সমতল ছাড়াও পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগণকেও এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত রাখা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় এথনিকদের জন্য ৮ হাজার ১০৬টি গৃহ ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৪ হাজার ৮৩২টি গৃহ বিতরণ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও পুকুর খননকৃত এলাকায় সমবায় পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সরকারি সহায়তায় বিভিন্ন পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ ব্যবসা বা কৃষি কাজের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বান্দাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প, হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প, দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকায় কয়লাখনি শ্রমিক, বরগুনার তালতলি এলাকায় রাখাইন পরিবারের জন্য বিশেষ টং ঘর ও নীলফামারীর সদর উপজেলায় হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ১১.৫
দরিদ্র ও অরক্ষিত পরিস্থিতিতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে রক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে পানি সম্পৃক্ত দুর্যোগসহ অন্যান্য দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ও মৃতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করা।
মন্তব্য: বন্যা, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে দৃশ্যমান সম্পদ যেমন- ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, গবাদিপশুসহ অন্যান্য অবকাঠামো। সেটি বিবেচনা করে প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রতিটি গৃহ তুলনামূলক উঁচুস্থানে নির্মিত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন বা অতিবৃষ্টির কারণে যাতে গৃহের ক্ষতি না হয় বা জনগণের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখে স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আওতায় মাটি ভরাটের জন্যও বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে যাতে আবাসস্থল সমূহ দুর্যোগ সহনীয় হয়ে ওঠে।
উপসংহার
এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সমন্বিত নীতি কাঠামো প্রণয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রধান কারণ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। একইসঙ্গে এসডিজিকে সমন্বিত করা হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) সাথে যা উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে বৃহৎ অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে সমাজের দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে একীভূত করেছে। মুজিববর্ষে বিশেষ উদ্যোগে সমাজের ছিন্নমূল মানুষকে জমি ও গৃহ প্রদানের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ‘যে আছে সবার পেছনে, পৌঁছাতে হবে তার কাছে আগে’- অগ্রাধিকার নীতি হিসেবে এটি গ্রহণের ফলে সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গতি আরো বাড়বে। বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্যের (শতকার ১০ দশমিক ৫ ভাগ) আওতাভুক্ত জনগনই গৃহায়ণ কর্মসূচির প্রধান উপকারভোগী। ফলে, স্বভাবতই দারিদ্র্য বিমোচনে এ প্রকল্প অনন্য সাধারণ। দেশের পিছিয়েপড়া এলাকা এ কার্যক্রমের সুবিধা পাচ্ছে। একই সাথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চা শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী. পরিবেশগত শরণার্থী, প্রতিবন্ধী, খনি শ্রমিক, কুষ্ঠ রোগী এবং অতি দরিদ্র নারীরা এ কর্মসূচির প্রধান উপকারভোগী। এসব পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য উপার্জন ও উৎপাদনশীল সম্পদে তাদের প্রাপ্যতা বাড়াতে এবং ন্যূনতম শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টির সংস্থান এ কর্মসূচির মাধ্যমে অর্জিত হওয়া সম্ভব। এসডিজি ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নের ফলে অসমতা কমানো, বিভিন্ন সেবায় প্রবেশগম্যতা, বিদ্যুৎ ও নিরাপদ পানি প্রাপ্তি এবং নাগরিক মর্যাদাকেন্দ্রিক বাধা-বিপত্তির অবসান হবে। একইসঙ্গে জেন্ডার ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কেন্দ্রিক অসমতাগুলো দূরীভূত হবে। শুধু গৃহায়ণের ফলেই কর্মসংস্থান ও উপার্জনের সুযোগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। গুচ্ছভিত্তিক আবাসনের ফলে সর্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একই স্থান থেকে দেওয়া হবে। ফলে, পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং স্বাস্থ্যসেবা সহকারীরা গ্রামীণ এলাকায় নিয়মিত উপকারভোগীদের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে সেবা দিতে পারবেন। স্থানীয় পর্যায়ে নির্মাণ সামগ্রী সরাসরি গ্রামীণ বাজার থেকে সংগ্রহের ফলে নির্মাণ ব্যয় তুলনামূলক কম হচ্ছে এবং একইসঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হচ্ছে। এই একটি প্রকল্পের মাধমেই পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নব দিগন্ত সূচনা হয়েছে বাংলাদেশের আকাশে।
লেখক: সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০২১
এএটি