২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে তাতমাদাও ও তাদের দোসরদের জেনোসাইডের শিকার হয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্তে চলে আসে। বাংলাদেশের কাছে তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় চায়।
প্রথমত, সন্ত্রাসবাদ। কোনো একটি জায়গায় যদি বিপুল বা সামান্য পরিমান মানুষের বসবাসও থাকে তবে সেখানে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়, এটা অনেকটা স্বাভাবিক। বিগত সাড়ে চার বছরের পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ধরন সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিতে পারে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ৮৯ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন৷… তাছাড়া কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় অস্ত্র মামলা হয়েছিল ১৩টি। পরের বছর তা বেড়ে হয় ১৭টি। ২০২০ সালে ২৭টি অস্ত্র মামলা হয়। চলতি বছরের নয় মাস ২৩ দিনে ১৫টি অস্ত্র মামলা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৪টি দেশীয় পিস্তল, ৪৪টি এলজি, তিনটি বিদেশি পিস্তল, ৩০টি একনলা বন্দুক, ২৫টি দেশি বন্দুক, চারটি পাইপগানসহ প্রচুর পরিমাণ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই সময়ের মধ্যে ১২৩টি অস্ত্র পুলিশ উদ্ধার করেছে। (ডিডব্লিউ, ২৩ অক্টোবর ২০২১)।
সম্প্রতি আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের’ (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ এবং মাত্র মাসখানেকের ব্যবধানে রোহিঙ্গাদের সংগঠন ইসলামি মাহাস পরিচালিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রসহ ছয়জনকে সন্ত্রাসীদের গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহতের ঘটনা। এই ঘটনার জন্য আরসাকে দায়ী করা হলেও আরসার অস্তিত্বের বিষয়কে সবসময় প্রত্যাখান করে আসছে নিরাপত্তা বাহিনী। এই ঘটনাগুলো থেকে কয়েকটি প্রশ্ন তো থেকেই যায়, ক্যাম্পে যদি আরসার মত সংগঠনের অস্তিত্ব নাই থাকে তবে এই ঘটনা গুলোর সাথে আরসার নাম কেন আসছে?; বিগত সাড়ে চার বছরে যে পরিমান অস্ত্রের পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সেই অস্ত্র কিভাবে ক্যাম্পের নিরাপত্তা চাদর ভেদ করে প্রবেশ করছে, কারা যোগান দিচ্ছে, কারাই বা অর্থ যোগান দিচ্ছে এবং এই সংগঠন বা যদি কোন ব্যক্তি এককভাবে হত্যা, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, অপহরণের মত নিরাপত্তা বিঘ্নিত কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকে তাদের পেছনের কলকাঠি নাড়ানোর জন্য দেশীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক কোন সন্ত্রাসী গ্রুপ বা মাফিয়াচক্র কাজ করছে কিনা সেটা গভীরভাবে পযবেক্ষণে এবং তদন্ত করতে হবে। শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলে সেটি ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, মানবপাচার। সারা বিশ্বব্যাপী মানবপাচারের বিষয়টি উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের মাঝে দরিদ্র্যতা, শিক্ষার অভাব এবং বেকারত্বের হারকে পুঁজি করে বিভিন্ন দেশে দেশে গড়ে উঠেছে মানবপাচার চক্র। মানুষের সবসময় সহজাত প্রবৃত্তিই থাকে একটা সুন্দর জীবন। সেই সুন্দর জীবনের ম্যাজিকাল বক্সের চাবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই মানবপাচারকারীরা। মানবপাচারকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের জীবন এবং পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঝুঁকির বাইরে বাংলাদেশও নয়। ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকাশিত “২০২১ ট্রাফিকিং ইন পারসন্স রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান স্তর-২ তে। “মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দেশে গত আট বছরে ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। তবে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ২৩৩টি। বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯০১টি মামলা। এর মধ্যে ৩৩টি মামলায় মাত্র ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ” ( সমকাল, ১০ জুন ২০২০)।
মানবপাচারের ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে নারী ও শিশুরা। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য আরও একটি মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে রোহিঙ্গাদের পাচার। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে মানবপাচারের জাল বিছিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই পাচারকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ের কক্সবাজারের ‘দি টেরিটরিয়াল নিউজ’, এর মানবপাচার বিষয়ক একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কিভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন নারী পুরুষকে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডে পাচার করছে। প্রথম মানব পাচারের জন্য বেকার বা সহজ সরল যুবককে টার্গেট করে থাইল্যান্ডের মানবপাচার চক্রের কাছে তুলে দেওয়া। পরবর্তীতে বিভিন্ন ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হবে এই বিনিময়ে পরিবারকে জিম্মি করা। এই তালিকায় রয়েছে নারীরাও। পাচারকারীরা এমনভাবে বৈধকাগজ প্রস্তুত করছে যেন মনে হয় বৈধ উপায়ে তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে। তবে যতক্ষণ না পাচারের শিকার পুরুষ বা নারীরা পাচারকারীদের হাতে না পড়ে তারা বুঝতেই পারে না যে তারা এখন জিম্মি।
পাচারকারীরা একটা লোভের এবং কর্মের ফাঁদ পেতে বিদেশে পাচার করে। আরও জানা যায়, একজন স্থানীয় বাঙালি রোহিঙ্গা নারীকে বিয়ে করেছে। তার মানে এখন লোভের বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে বাঙালি এবং রোহিঙ্গা মধ্যে বিয়ে হচ্ছে। এর ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে স্থানীয় মানুষেরাও। এই পাচারকারীরা গোপনে গোপনে বিভিন্ন কাজে নারীদেরকে পাচার করছে। একটি বিষয় জানা দরকার, কি পরিমান শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পে তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়ত কারও জানা নেই। আবার বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পের মধ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে কি হচ্ছে সেই গোপনীয়তাকে ব্যাবহার করে প্রথমে পাচারকারীরা এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে সময় সুযোগ বুঝে পাচার করে দিচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, থাইল্যান্ড কেন? আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, থাইল্যান্ড একটি টুরিস্ট এলাকা এবং মূলত সেক্স ট্যুরিজমের জন্য বিখ্যাত। বিভিন্ন বয়সের নারীদের নিয়ে এই ব্যবসা সহজে করা যায়। আরও একটি বিষয়, বিভিন্ন অঙ্গের ব্যবসার জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে পাচারের শিকার মানুষদেরকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কতদিন ধরে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে কি পরিমান রোহিঙ্গাদেরকে ক্যাম্প থেকে বের করে পাচার করা হয়েছে সেটাকে জোরালোভাবে তদন্ত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি। মানবপাচারকে জোরালোভাবে রোধ করার জন্য নিতে হবে কার্যকরী ব্যবস্থা।
তৃতীয়ত, মাদক চোরাচালান। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থান পরিণত হচ্ছে মাদকের আখড়া হিসেবে, যার বাস্তবতা পাওয়া যায় পত্রিকায় বা টিভিতে সম্প্রচারিত সংবাদে চোখ বুলালে। প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে মাদকের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। পূর্ব থেকেই মিয়ানমার সীমান্ত ছিল মাদকপাচারের ঝুঁকিতে। গত ২৬ নভেম্বর কক্সবাজার টেকনাফে বিজিবি সদস্যরা অভিযান চালিয়ে মালিকবিহীন ২ লাখ পিস ইয়াবার চালান উদ্ধার করে (আমাদের টেকনাফ, ২৬ নভেম্বর ২০২১)। এইভাবে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে মাদকের বড় বড় চালান।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক পরিস্থিতি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে মাদকের মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২টি; গড়ে মাসে প্রায় ১৩টি। ২০২০ সালে যা ছিল ২৫৬টি; গড়ে মাসে ২১ দশমিক ৩৩টি। চলতি বছরের আট মাসে (অগাস্ট পর্যন্ত) হয়েছে ১৮৪টি; গড়ে মাসে মামলার সংখ্যা ২৩টি। (বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৩ অক্টোবর ২০২১)। মাদকের ব্যবসায় আধিপত্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন গ্রুপ, গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। মাদক চোরাকারবারীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে খুবই সক্রিয়, তা পরিসংখ্যান এবং গণমাধ্যমের তথ্য থেকে পাওয়া যায়। এটি আগামীর জন্য চরম ঝুঁকি।
চতুর্থত, তথ্যপাচার। অনেকটা এই বিষয়ে ধোঁয়াশা থাকতে পারে কিভাবে তথ্য পাচার হয়। একটি বিষয় মনে রাখা দরকার ডিজিটাল যুগে সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে এই তথ্য পাচার খুবই সহজ। বহনকারী কোন কাগজ বা ফাইল বা অন্য কোন ডিভাইস বহন না করেও শুধুমাত্র প্রযুক্তির কল্যাণে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য এই তথ্য পাচার বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্তবর্তী মংডুর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় মোবাইল ফ্রিকোয়েন্সি টাওয়ার বসিয়েছে মিয়ানমার। মংডু সীমান্তসহ আশপাশের এলাকায় এমপিটি (মিয়ানমার পোস্টস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনস) নামের একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানের টাওয়ার বসিয়ে বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড (নিবন্ধিত) সিম পাঠাচ্ছে তারা। এসব সিম ব্যবহার করছেন অপরাধীরা (কক্সবাংলা.কম, ০১ জুলাই ২০২১)। কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প এলাকায় মিয়ানমারের একাধিক মোবাইল অপারেটরের সিমকার্ড গোপনে বিক্রি হয়, সেটাও পাওয়া যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে। এই মোবাইল টাওয়ারের মাধ্যমে মায়ানমার থেকে নজরদারি করা সহজসাধ্য। একটি দেশের ভূখণ্ডে অন্য একটি দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের ব্যাবহার এবং সিমের ব্যাবহার কতটা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভিনদেশের নেটওয়ার্কের প্রবেশ বন্ধ করতে না পারলে সেটি রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার পথে বিরাট হুমকি হতে পারে।
নানা প্রাকৃতিক ঝুঁকির পাশাপাশি কৃত্রিম ঝুঁকির মধ্যে বিরাজমান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন এবং সংকটের সমাধানের বিলম্বের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে নানা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চলেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্রচক্র। এই ষড়যন্ত্রের জাল যতই বিস্তার করবে ততই তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এবং কক্সবাজার ভূখণ্ডকে। এই ঝুঁকির আঁচ বাংলাদেশের এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাতে যে ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক: জি এম আরিফুজ্জামান, রিসার্স অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]