ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ মাঘ ১৪৩১, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭ শাবান ১৪৪৬

রাজনীতি

ধানমন্ডির ঘটনায় যেভাবে সংগঠিত হলো ছাত্র-জনতা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫
ধানমন্ডির ঘটনায় যেভাবে সংগঠিত হলো ছাত্র-জনতা ধানমন্ডিতে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়ির সামনে ছাত্র-জনতা। ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। তারা বলছেন, এটি ছিল ফ্যাসিবাদের আস্তানা, তাই সেটিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

আগ্রহ তৈরি হয়েছে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ছাত্র-জনতার সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানমন্ডির ঘটনাটি মূলত জুলাই বিপ্লবীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। শেখ হাসিনা নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একটি ভার্চুয়াল আয়োজনে বক্তব্য দেবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হলে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। দেশি-বিদেশি অ্যাক্টিভিস্ট ও বৈষম্যবিরোধীরা অনলাইনে প্রচারণা চালিয়েই সংগঠিত হয়ে ধানমন্ডি অভিমুখে মার্চ করেন এবং সেই বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেন।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ষষ্ঠ মাস পূর্ণ হয়েছে ৫ ফেব্রুয়ারি (বুধবার)। আন্দোলনকারীদের ভাষ্যে, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা জুলাইজুড়ে হত্যার জন্য পতনের আগেও কোনো আফসোস করেননি। এমনকি ভারতে আশ্রয়ে থাকাকালে তার যেসব বক্তব্য-বিবৃতি প্রচার পাচ্ছে, তাতেও কোনো অনুশোচনাবোধ প্রকাশ পাচ্ছে না।

উপরন্তু  তার সরকারের নির্দেশে তৎকালীন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রকাশ্যে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে মারার শত শত ফুটেজ অনলাইনে প্রকাশ পেলেও হাসিনা বক্তব্য-বিবৃতিতে দম্ভ ও তাচ্ছিল্যভরে আন্দোলনকারীদেরই দুষছেন।

অনুশোচনার বদলে তার এ ধরনের দম্ভ ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য আরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে ছাত্র-জনতাকে। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে আগে থেকে প্রচারণা চালিয়ে তিনি যেন সেই ক্ষোভের আগুন উসকে দেন।

ভাষণের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ার পর আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। তাদের অভিযোগ, ভারতে বসে ভাষণ দিয়ে শেখ হাসিনা বিদ্বেষের আগুন ছড়াচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে মার্চ করার ঘোষণা দেয়।

সন্ধ্যার পর থেকেই সেখানে সমবেত হতে থাকে ছাত্র-জনতা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, রাত ৯টায় শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল ভাষণের সময় নির্ধারিত ছিল। যদিও হাসিনার অডিও ভাষণ প্রচার হয়। তার এ ভাষণকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে বাড়িটিতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে এক্সকেভেটর ও ভেকু মেশিন নিয়ে বাড়িটি ভেঙে ফেলে। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকতেন শেখ মুজিব। বাড়িটি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু হতো ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে। এমনকি হাসিনার অনুগত অনেক সরকারি আমলাও এখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করতেন।

যেভাবে জড়ো হলেন বিক্ষুব্ধরা
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হুমকি-ধমকির কারণে আগে থেকেই শেখ হাসিনার প্রতি আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ জমছিল। এর মধ্যে তিনি ৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ভার্চুয়াল প্রোগ্রামে ভাষণ দেবেন বলে প্রচারণা চালালে জুলাই বিপ্লবীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

দেশ-বিদেশে অবস্থানরত অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখা সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। তারা অভিযোগ করতে থাকেন, ফ্যাসিবাদ আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ খুঁজছে, যা দেশের ছাত্র-জনতা কখনোই হতে দেবে না।

হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার প্রচারণা দেখে প্রথমে ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ফেসবুকে পোস্ট দেন।

হাসনাত লেখেন, ‘হাসিনাকে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়াকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে দেখি। ’

তার আগে আরিফ সোহেল লেখেন, “বাংলাদেশের ছাত্রদের ওপর নৃশংসতম গণহত্যা চালানোর পরে ছাত্রসমাজের উদ্দেশ্যেই দিল্লিতে বসে ভাষণ দেওয়ার মত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে হাসিনা। এমন নির্লজ্জতার প্রতিবাদে আগামীকাল রাত ৯টায় (যখন হাসিনার ভাষণ দেওয়ার কথা) ঢাকা শহরের প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে জুলাই গণহত্যার ভিডিও, ডকুমেন্টারি, ছবি প্রদর্শন করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আপনারা সারা দেশের প্রত্যেকটি মোড়ে মোড়ে, বাজার-হাটে জুলাই গণহত্যার ভিডিও প্রচার করুন। আগামীকাল রাত ৯টায় বাংলাদেশের সব সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’র ওপরে বিশেষ বুলেটিন প্রচার করতে হবে। এখানে কোনো সুশীলতা চলবে না। করতে হবে মানে করতেই হবে। এটাতে মিডিয়ার ঈমান পরীক্ষা হবে। আর যদি কোনো টিভি-চ্যানেল হাসিনার বক্তৃতা প্রচার করার দুঃসাহস দেখায়, তবে ছাত্র-জনতা তাদের শেষ দেখে ছাড়বে। ”

সেদিন বিকেলে অভ্যুত্থানকারীদের অন্যতম প্লাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ উসমান বিন হাদী তার আইডিতে লেখেন, ‘রাত ৯টায় ৩২!  ঠিকাছে?’

প্রায় একই সময়ে প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন তার ফেসবুকে একটি ফটোকার্ডে কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘হাজারো ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে ২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে আজ রাত ৯টায় ধানমন্ডি অভিমুখে বুলডোজার মিছিল হবে। ’

প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ও লেখক পিনাকী ভট্টাচার্যও সেদিন বিকেলে এ সংক্রান্ত একাধিক পোস্ট দেন। এর একটিতে তিনি লেখেন, ‘থাকবে না- ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার থাকবে না। ’

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট রাতুল মোহাম্মদ একই সময়ে লেখেন, ‘আজ রাত ৮টায় শাহবাগ থেকে ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হলো। ’

সন্ধ্যায় হাসনাত আব্দুল্লাহ আরেক পোস্টে বলেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে। ’

রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাসনাত আরেকটি পোস্টে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের চিহ্ন বিলোপের সাথে সাথে খুনি হাসিনাসহ গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ’

এই পোস্টগুলো ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে শত শত শেয়ার হয়। ছড়িয়ে পড়তে থাকে অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে। তারা সাড়া দেন ধানমন্ডি যাওয়ার আহ্বানে।  

সন্ধ্যার পর থেকেই বিপুল সমাগম হতে থাকে ৩২ নম্বর এলাকায়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বাড়িটির ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে এক্সকেভেটর ও ভেকু মেশিন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর ৫ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ ছয় মাসের মাথায় বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে আওয়ামী লীগ। এমনকি ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা তারা করছিল, সেটাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জুলাই হত্যার জন্য অনুশোচনা না করে বা নমনীয় না হয়ে উপরন্তু বিদেশে বসে সহিংসতার উসকানি দিচ্ছেন বিদেশে পালিয়ে নিরাপদে বিলাসী জীবনযাপন করতে থাকা আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট। আন্দোলনকারীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা নানান বক্তব্য ছড়াচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড দেশে থাকা আওয়ামী লীগের নিরীহ কর্মী-সমর্থকদের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে। কোটা আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনার হঠকারিতা তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও বজায় থাকলে তা আওয়ামী লীগের আরও বিপর্যয় ডেকে আনবে। শেখ হাসিনার ফাঁদে পড়ে আওয়ামী লীগ আরও ক্ষয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৩৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।