ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

ত্যাগীদের বাদ দিয়ে মহিলা দলের মহানগর কমিটি

মহসিন হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২
ত্যাগীদের বাদ দিয়ে মহিলা দলের মহানগর কমিটি

ঢাকা: জাতীয়তাবাদী মহিলা দল ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার ১০ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক আহ্বায়ক কমিটি ও মহানগর দক্ষিণ শাখার ১০ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে গত ১১ জানুয়ারি। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আফরোজা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ ওই কমিটি অনুমোদন করেন।

ওই কমিটিতে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের নিয়ে পুরোনো নেতৃত্ব ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন পুরোনো কমিটির নেত্রীরা। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টন কার্যালয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছে অভিযোগপত্রটি হস্তান্তর করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সভাপতি রাজিয়া আলিম, সাধারণ সম্পাদক শামসুন্নাহার ভূইয়া ও উত্তরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাবেয়া আলম। এ সময় দুই মহানগরের বিভিন্ন থানার অর্ধশতাধিক নেত্রী তাদের সঙ্গে ছিলেন বলে জানা গেছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে মহিলা দলে ব্যাপক তোলপাড় চলছে।

জানতে চাইলে মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, উত্তরের কমিটি নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। দক্ষিণের বিষয়টি আমি বলতে পারবো না। তিনি দাবি করেন, অভিযোগকারীদের মধ্যে উত্তরের মাত্র দুজন ছিলেন। তারা হলেন রাবেয়া ও তামান্না।

তবে উত্তরের সভাপতি প্রার্থী খন্দকার ফরহানা ইয়াসমিন আতিকা বাংলানিউজকে বলেন, উত্তরের ২৬টি থানার মধ্যে ২২টি থানার প্রতিনিধিরা ওই অভিযোগ দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখলেই বুঝতে পারবেন উত্তরের নেত্রীরা ছিলেন কিনা।

সুলতানা আহমেদ বলেন, মহানগর কমিটি ভেঙে দিয়েছে। এখন কমিটি করতে হবে না? নেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করে কী কখনও কমিটি হয়? কমিটিতো লিডারদের (বিএনপি নেতাদের) সঙ্গে কথা বলে করা হয়। থানা- ওয়ার্ডের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো কমিটি কেউ দিতে পারে? কোনো দিন কেউ পেরেছে?

দক্ষিণের ব্যাপারটা তার এখতিয়ারের বাইরে দাবি করে সুলতানা বলেন, দক্ষিণের কমিটির বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। উত্তরের যে কয়জন মেয়েকে কমিটিতে দেওয়া হয়েছে তারা সবাই শিক্ষিত। অনেক সময় কমিটি করতে গেলে একটু আধটু অভিযোগ থাকেই। কমিটি যতই ভালো দেবেন কিছু না কিছু, কারও না কারও অভিযোগ থাকবেই। এটা সারাজীবন দেখে আসছেন আপনারা।

অভিযোগ করা হয়েছে অধিকাংশ ত্যাগী নেত্রীরা স্থান পাননি- জবাবে সুলতানা বলেন, তারা কমিটিতে চলে আসবেন। এটাতো তিন মাসের আহ্বায়ক আংশিক কমিটি। পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি হবে, তারপর ওয়ার্ড ও থানা কমিটি হবে, সব মেয়েরাই কমিটিতে চলে আসবে।

ঢাকা মহানগর কমিটি দুই ভাগ হওয়ার আগের কমিটির দপ্তর সম্পাদক ও উত্তরের সভাপতি পদ প্রত্যাশী খন্দকার ফরহানা ইয়াসমিন আতিকা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দলের চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দিয়েছি। আমি ইডেন কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলাম। ঢাকা মহানগর ছাত্রদলে নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও সাইফুল আলম নীরব কমিটির ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। একদিনে রাজনীতিতে আসিনি। তৃণমূল থেকে রাজনীতি করছি। গত কমিটিতে আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু শিরিন আপার পক্ষে থাকায় আমাকে তখন যাচ্ছে তাই একটা পদ দেওয়া হয়েছিল। তখন মেনে নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম। রাজপথ থেকে সরে যাইনি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার মহানগর উত্তরের সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। আমাকে দেওয়া হয়নি, অন্য যারা সভাপতি হতে চেয়েছিল তারা আমার জুনিয়র হলেও তাদের অনেক বছরের রাজনীতির ইতিহাস আছে। কিন্তু তাদের কাউকে না দিয়ে যারা ৩/৪ বছর ধরে রাজনীতিতে এসেছেন তাদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিতো আমরা মেনে নিতে পারি না। আমি এর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলাম। এ কমিটি বাদ দিয়ে নতুন কমিটি দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।

উত্তরের কমিটিতে যাকে আহ্বায়ক করা হয়েছে তিনি হলেন, বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে চৌধুরী নায়েবা ইউসুফ। তার বিষয়ে আতিকা বলেন, তিনি ফরিদপুর পৌরসভায় দল থেকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। উনি কখনও ঢাকা মহানগরের রাজনীতি করেননি। মহিলা দলে উনার প্রথম পদই হলো কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক। তারপর উনি উনার বাবার এলাকা থেকে মেয়র নির্বাচন করেছেন। এখন উনি মহানগরে এসেছেন। যারা মেয়র নির্বাচন করেন তারা এমপি লেভেলের নেত্রী। সেখান থেকে এসে উনি যদি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দাঁড়াতে চান। তাহলে আমরা যারা এত বছর রাজনীতি করছি আমরা কোথায় যাব। উনার রাজনীতির বয়স তিন বছর, আমার রাজনীতির বয়স ৩৩ বছর।

আতিকা অভিযোগ করেন, রাবেয়া আলম ও রোকেয়া সুলতানা তামান্নাকে দুই ও তিন নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে। তাদের অপদস্থ করার জন্য অপেক্ষাকৃত জুনিয়ার লাইলী বেগমকে করা হয়েছে এক নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক। অথচ আমরা যখন মহানগরে ছিলাম তখন এই লাইলী বেগম একটি ওয়ার্ডের সভাপতি হওয়ার আবেদন করেছিলেন। তখন তাকে সে পদও দেওয়া হয়নি। এখন তাকে মহানগর উত্তরের এক নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সভাপতি রাজিয়া আলিম বাংলানিউজকে বলেন, আমিতো বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। নতুন কমিটিতে আমাকে রাখাটা বড় বিষয় না। বিষয় হলো এটা কোনো কমিটি হয়েছে? পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে তিনি বলেন, দক্ষিণে যে কমিটি হলো এটা কী কমিটি? এটা পকেট কমিটিও না, জাতেরও না গোতেরও না। এরা বিএনপির কে? এদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আমরা কী রাজনীতি করবো?

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক এই কাউন্সিলর বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় দেড় বছর জেল খেটেছি।  

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর চিঠি দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, আমরা কোনো পত্রিকায় বিষয়টি দেইনি। আমাদের কাছ থেকে রিজভী আহমেদ দুই দিনের সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু চার দিন হয়ে গেছে, এখন আমরা মিডিয়ায় বিষয়টি দেব।

কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আফরোজা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, তারা সব দোষ দেন ভাইয়ার (তারেক রহমান)। তাদের নাকি সব ভাইয়া বলেছেন। ভালো কথা, আমরাও ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাই।  

নতুন কমিটি দেওয়ার বিষয়ে অভিযোগ কী জানতে চাইলে রাজিয়া আলিম বলেন, পুরোনো কমিটি বিলুপ্ত না করে হঠাৎ করে কমিটি দেওয়া হয়েছে। এটা গঠনতান্ত্রিকভাবে হয়নি। যাদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে তারা কোথায় কীভাবে রাজনীতি করেছেন। তাদের কারা চেনে? মহানগরে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা তাদের নেই। এ কমিটি বাতিল করে নতুন করে কমিটি দিতে হবে।

কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজিয়া আলিম বলেন, এটাইতো বলছি, আবোল-তাবোল কমিটি হয়েছে। তাদেরতো পরিচিতি নেই। কেউ তাদের কেউ চেনেন না। তারা মহিলা দলের কোন থানায় ছিলেন? আমি সভাপতি হিসেবে যে কমিটি করলাম, ২০১৬ সালে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যে কমিটি দিলেন সেই কমিটির মধ্যে সুপার ফাইভ উত্তর ও দক্ষিণে পাঁচজন করে দিয়েছিল। তারপর গত পাঁচ বছর যে কাজ করলাম ৭৫টা ওয়ার্ড কমিটি, ২২০টা ইউনিট কমিটি। পুরো ঢাকা চষে বেড়ালাম। এরা কি এসব কিছু জানে? একটা ছাত্রদল কমিটি দিয়েছে, সেটা বাদ দিলাম, বাকিগুলো কোথায় ছিল?

মহানগর দক্ষিণের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামসুন্নাহার ভূইয়া বাংলানিউজকে বলেন, একটা কমিটি করতে হলে পুরোনো কমিটি ভেঙে দিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে সম্মেলন করে তারপর নতুন কমিটি করতে হয়। ঘরে বসে পকেট কমিটি করা ঠিক না। যারা যোগ্য দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত বিগত দিনে পরিশ্রম করেছে তাদের বাদ দিয়ে যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামে নেই, অনেককে চিনে না এমন নতুন মুখ কমিটিতে দিয়েছে। ঢাকা মহানগরে নেতৃত্ব দিতে যে যোগ্যতা লাগে। যাদের দিয়েছে তাদের মধ্যে সেটা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।  বিতর্কিতদের এখানে আনা হয়েছে। আমাদের দাবি এই কমিটি বাতিল করতে হবে। যোগ্য এবং থানা পর্যায়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি দিতে হবে।
 
এ কমিটির জন্য কাদেরকে দায়ী করছেন জানতে চাইলে শামসুন্নাহার ভূইয়া বলেন, যারা কমিটি করেছে তারাই দায়ী। আমি কারও নাম বলতে চাই না। এ অগণতান্ত্রিক কাজ যারা করেছেন তারা দলকে সংগঠিত করাতো দূরের কথা বিশৃঙ্খলা করেছে। চেয়ারম্যানের কাছে তাদের জবাব দেওয়া উচিত।

রুহুল কবির রিজভীর কাছে অভিযোগ দিতে কতজন গিয়েছিলেন? জবাবে শামুসন্নাহার বলেন, সেখানে দক্ষিণের ১৪টি  থানা ও উত্তরের প্রায় শতাধিক মহিলা নেত্রী গিয়েছিলেন।

রিজভী আহমেদ আপনাদের কী বলেছেন জানতে চাইলে শামুসন্নাহার বলেন, তিনি সবাইকে চেনেন। তাদের জিজ্ঞাসা করেছেন আপনারা কী কেউ কমিটিতে নেই? তখন আমরা বলেছি যে না। তখন তিনি বলেছেন তাহলে কী কমিটি হলো?

শামসুন্নাহার বলেন, আমার কথা হলো মহিলা দল একটি সুশৃঙ্খল দল। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া কারাবন্দি, চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। এ মুহূর্তে এমন একটা শক্তিশালী দল করা উচিত যারা আগের কমিটিতে ছিলেন।  

ঘোষিত আংশিক ওই কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে তারা হলেন:

মহানগর উত্তর: আহ্বায়ক নায়েবা ইউসুফ, যুগ্ম আহ্বায়ক লাইলী বেগম, রাবেয়া আলম, রোকেয়া সুলতানা তামান্না, স্বপ্না আহমেদ, তাহমিনা আরফিন নিতা, বুলবুল নাহার, তাহমিনা আক্তার তন্বী, অ্যাডভোকেট আঞ্জুমান আরা শিউলি ও সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট রুনা লায়লা রুনা।

মহানগর দক্ষিণ: আহ্বায়ক রুমা আক্তার, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহীনুর নার্গিস, হোসনে আরা লিজা, সালেহা বেগম, হাসিনা বেগম হাসি, রেহেনা ইয়াসমিন ডলি, ফেরদাউসি বেগম, রাশিদা বেগম, জাহানারা বেগম ও সদস্য সচিব নাসিমা আক্তার কেয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২
এমএইচ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।