ঢাকা, শনিবার, ২০ পৌষ ১৪৩১, ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩ রজব ১৪৪৬

সালতামামি

ফেনীর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

যে বন্যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নাড়া দেয় বিশ্বময়

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২৫
যে বন্যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নাড়া দেয় বিশ্বময় ভয়াবহ বন্যায় ডুবন্ত ফেনী জেলা শহর: ফাইল ফটো

ফেনী: ২০২৪ সালের আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার আঘাত লাগে ফেনীর সবকটি উপজেলায়। সেসব দিন মনে হলে এখনও আঁতকে উঠেন এ জনপদের মানুষ।

গ্রাম ছাড়িয়ে এ বন্যায় ডুবে যায় জেলা শহরও। জেলা শহরের অনেক মহল্লায় ডুবে যায় বহুতল ভবনের নিচতলার পুরোটা। কিছু এলাকা পানি দোতলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অবস্থা এমন ভয়াবহ ছিল মৃত্যুর পর কবর দেওয়ার জন্য শুকনো মাটির দেখাও পায়নি মানুষ।  

পানিবন্দি ছিলেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। দাপ্তরিক হিসেবেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জনের বেশি মানুষ। ক্ষতি হয় প্রায় সব সেক্টরে। শহর থেকে গ্রাম ক্ষতির চিহ্ন সবখানে। এ বন্যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নাড়া দেয় বিশ্বময়।

সারাদেশের মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ছুটে আসে বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ করতে। মানুষের এ সহায়তায় কথা ফেনীর মানুষ কখনোই ভুলতে পারবেন না।

ফেনীর এ বন্যার প্রভাব ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে পাশের জেলা নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরেও।

চার মাস পেরিয়ে গেলেও ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ এখনও দুর্গতদের। জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, সোনাগাজী ও সদরের এখনও অনেক মানুষ গৃহহীন। এ বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হিসেবের অঙ্কে যা ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ২০ লাখ ৫০০ টাকার বেশি।

ক্ষতি নিরূপণে কৃষিখাত, সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মোটরযান, ঘরবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষতি নিরূপণ করে উল্লেখিত ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা হয়েছে।

কৃষিখাতে ফসল, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে আনুমানিক ক্ষতি নিরূপণ করেছে ৯১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ বিভাগ পোল্ট্রি এবং লাইভস্টকে ক্ষতি নিরূপণ করেছে প্রায় ৩৯৬ কোটি টাকা। তবে পোল্ট্রি উদ্যোক্তারা তাদের ক্ষতির পরিমাণ দাবি করেছেন ৪০০ কোটি টাকা। এ ক্ষতির আনুমানিক হিসেব দাঁড়ায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

এবারের বন্যায় ফেনীতে গ্রামীণ, আঞ্চলিক ও মহাসড়কে ১৪০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। একইভাবে ৮৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দপ্তরে বন্যায় ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে ৩৮ কোটি ৭২ লাখ ৫০০ টাকা। মোটরযানে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে প্রায় ৬১ কোটি টাকা।  

বন্যায় অবকাঠামো অর্থাৎ, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সামগ্রির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপিত হয়েছে আনুমানিক ৬৯২ কোটি টাকা এবং জেলাজুড়ে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং শিল্প-কারখানার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে আনুমানিক ৫৫৪ কোটি টাকা।

একদিকে যেমন আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়, ফেনীর মানুষের কাছে এবারের বন্যা ছিল এমনই। জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা শুরুতে বন্যাকবলিত হলেও পরে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে ফেনীর মানুষের জীবনে। টেলিযোগাযোগসহ সব ধরনের যোগাযোগ থমকে যায়। এ জেলার অনেক প্রবীণ বাসিন্দাদের স্মৃতিতে এমন বন্যার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই আকস্মিক বন্যায় পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও পাননি অনেকে।

স্মরণকালের এ ভয়াবহ বন্যায় সম্পদহানির পাশাপাশি ঘটেছে ব্যাপক প্রাণহানিও। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ফেনীতে বন্যায় ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে ৯ জনের পরিচয় মেলেনি। জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি গণমাধ্যমের।

আকস্মিক এ বন্যার জন্য স্থানীয় মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতকে দায়ী করছেন। যদিও ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা নিত্য ঘটনা। এর সঙ্গে লড়াই করে এসব অঞ্চলের মানুষেরা টিকে থাকলেও, এবারের বন্যা তাদের সমস্ত ধারণা পাল্টে দিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারত সরকার কোনো ধরনের সতর্কবার্তা না দিয়েই ফেনীর পাশের রাজ্য ত্রিপুরার ধলাই জেলায় গোমতী নদীর ওপরে থাকা ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দিয়েছে। ফলে অস্বাভাবিক এ বন্যা দেখা দিয়েছে।

বেসরকারি সংস্থা অক্সফাম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বন্যায় ফেনীর ৯০ শতাংশ মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ডুবে গেছে। জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, দুর্গত জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পানি নেমে গেলেও এ ক্ষতিপূরণে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ফেনীতে এমন মানবিক বিপর্যয়ের পেছনে স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুর্ভোগের কারণ ভারত।

কেউ কেউ এর মধ্যে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে বলেও মনে করছেন। এ নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। ফেনীর এ মানবিক বিপর্যয় কাটাতে ক্রমেই ক্ষতিপূরণের দাবি জোরালো হচ্ছে।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এটা স্পষ্ট ফেনীর ২৪ এর এ বন্যা ভারতের চাপিয়ে দেওয়া। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই ডুবিয়ে মানুষ মেরেছে। এটার ক্ষতিপুরণ দেওয়া উচিত এ দেশের।  


বাংলাদেশ সময়: ১৫১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০২৫
এসএইচডি/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।