ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

আলোচনায় ছিল চার হত্যাকাণ্ড

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
আলোচনায় ছিল চার হত্যাকাণ্ড

২০২০ সাল একেবারেই শেষের পথে। সময়ের দরজায় কড়া নাড়ছে ২০২১।

নতুন বছর ভালো কাটবে এই প্রত্যাশা নিয়ে সবাই ২০২০-কে বিদায় জানাতে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের আক্রমণ দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০ সাল। সারা বিশ্বসহ বাংলাদেশের জনমানুষ নিজেদের জীবন বাঁচাতে যখন করোনার সঙ্গে লড়াই করছে, ঠিক এমনই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেশের চার স্থানে নারকীয় চার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যায়।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজার-টেকনাফে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এর দুই মাস পর অর্থাৎ ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট মেট্রোপলিটনের আখালিয়া রায়হান আহমদ বন্দর বাজার ফাঁড়ির পুলিশের নির্যাতনে নিহত হন। ওই মাসের ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ‘কোরআন শরীফ’ এর অবমাননার গুজব রটিয়ে এক যুবককে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এরপর ২০২০সালের শেষের দিকে ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরে মানসিক চিকিৎসা নিতে গেলে পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনিসুল ইসলাম ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মারধরে নিহত হন।

মর্মান্তিক এই চারটি হত্যাকাণ্ড ২০২০ সালকে যেন বিষাক্ত করে তুলেছিল। দেশের আপামর জনগণের মনে একটা দাগ কেটে যায় ঘটনাগুলো। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবিও জানান দেশের সচেতন নাগরিকরা। পরিশেষে দোষীদের গ্রেফতারের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনে বাংলাদেশ পুলিশ।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড:
সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ ইউটিউবে ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে কক্সবাজারের হিমছড়িতে প্রায় একমাস ধরে অবস্থান করছিলেন। ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে সহযোগিতার জন্য তার সঙ্গে ছিলেন বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে ডকুমেন্টারির শ্যুট শেষে ফেরার পথে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। এমন সময় বাহারছড়া এপিবিএন এর চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী সিনহাকে লক্ষ্য করে চারটি গুলি ছোড়েন। এতে নিহত হন সিনহা। শুধু তাই নয়, ওসি প্রদীপ কুমার ঘটনাস্থলে এসে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।  

ঘটনার পর সিফাতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে গ্রেফতার করে টেকনাফ থানা পুলিশ। ওই রাতেই সিনহা নিহতের ঘটনায় এবং গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ওই মামলায় সিনহা এবং সিফাতকে আসামি করা হয়। অপরদিকে নীলিমা রিসোর্ট থেকে মাদকসহ শিপ্রাকে গ্রেফতার করার পর তার বিরুদ্ধে রামু থানায় একটি মাদকের মামলা দায়ের করে পুলিশ।

এই ঘটনায় পুলিশের দেওয়া বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকৈ উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগগুলোও নতুন করে আলোচনায় আসতে শুরু থাকে। নিহত মেজর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ৫ অগাস্ট টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ নয় জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার এলিটফোর্স র‌্যাবকে দেওয়া হয়।

তদন্ত কার‌্যক্রম শেষে মেজর সিনহা হত্যার মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া ক্যাম্পের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব। গত ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‍্যাব-১৫ এর দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম কক্সবাজার আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন। তদন্তে প্রমাণ মিলেছে, ওসি প্রদীপের নির্দেশেই সিনহাকে গুলি করে হত্যা করেছেন পরিদর্শক লিয়াকত। কারণ ওসি প্রদীপের মাদক বাণিজ্য, নির‌্যাতন ও বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য সিনহা জেনে গিয়েছিলেন। এদিকে সিনহার সঙ্গী সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে পুলিশ মাদক আইনে করা দুটি মামলার সত্যতা না পাওয়ায় আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন।

মামলার অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে- পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ মোস্তফা, এপিবিএন এর তিন সদস্য এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং সাবেক এএসআই সাগর দেব। এদের মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি একজন কনস্টেবল পলাতক রয়েছে। পলাতক আসামি সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

সিলেটে পুলিশের নির‌্যাতনে রায়হান হত্যা:
ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে সিলেট মেট্রোপলিটনের বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনের কারণে রায়হান আহমদ নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। নিহত ওই যুবক সিলেটের আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর ভোরে এই ঘটনাটি ঘটে। ওই সময় সিলেট বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ছিলেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া।

এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদি হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন পালিয়ে যায়। পরে রায়হান হত্যার অভিযোগে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩ জনকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ পুলিশ। রায়হান হত্যা মামলার ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী এই হত্যা মামলার তদন্তে দায়িত্ব অবহেলার দায়ে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র এবং এসআই আব্দুল বাতেন ভুঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

প্রায় এক মাস আত্মগোপনে থাকার পর গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পাটগ্রামে গুজব রটিয়ে যুবককে পুড়িয়ে হত্যা:
২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের স্থলবন্দরের একটি মসজিদের বাইরে আবু ইউনুস মো. শহিদুন্নবী জুয়েল (৪৫) নামের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে স্থানীয়রা। এরপর মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তার বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার গুজব রটানো হলে স্থানীয়রা তাদের পুড়িয়ে হত্যা করে। আবু ইউনুসকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ আগুন দিয়ে পোড়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সারাদেশে।

এই ঘটনায় ৩টি মামলায় ১১৪ নামধারী ও অজ্ঞাত কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার প্রধান আসামি অভিযুক্ত আবুল হোসেন ওরফে হোসেন আলী, খাদেম জোবায়েদ আলী ওরফে জুবেদ আলী এবং মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিনসহ সর্বমোট ৩৬ জন আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডটি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে।

হাসপাতালের কর্মচারীদের মারধরে পুলিশের এএসপি’র মৃত্যু:
মানসিক রোগে আক্রান্ত সিনিয়ার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনিসুলকে রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান তার পরিবারের সদস্যরা। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালের একটি কক্ষে জোরপূর্বক তাকে ঢুকানোর সময় নিরাময় কেন্দ্রের কর্মচারীদের ধস্তাধস্তির এক পর‌্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন পুলিশের এই এএসপি। অচেতন অবস্থায় এএসপি আনিসুলকে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর ঘটনাটি ঘটেছিল। এর পরদিন (১০ নভেম্বর) মাইন্ড এইড নিরাময় কেন্দ্রের মালিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় একটি  হত্যা মামলা দায়ের করেন আনিসুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ।

এই ঘটনায় এখন পর‌্যন্ত জাতীয় মানসিক ইন্সটিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ১২ জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৬ আসামি হত্যার স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে। শুধুমাত্র হাসপাতালের একজন পরিচালক ডা. নিয়াজ মোর্শেদ পুলিশ প্রহরায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এএসপি আনিসুলকে মারধরের ঘটনায় মাইন্ড এইড হাসপাতালের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে ধরা পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ফুটেজ ভাইরাল হয়ে যায়। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে এ হত্যাকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আনিসুলের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়ার পর ২০২১ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এসজেএ/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।