‘ব্যাটার লাশ আগের দিন দিল না, পরের দিন লাশ পাইলাম, খবর পাইল্যাম হাসিনা পালাইছে। হাসিনা যদি আগের দিন পালাইতো তাইলে আমার ব্যাটা বাইচা থাকত।
সিরাজগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সুমন শেখের (২৮) মা ফিরোজা বেগম একবুক নিশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলছিলেন।
৫ আগস্টের পর থেকে প্রতিটা দিন গুণে রেখেছেন তিনি। ১০ মাস ২৪ দিন পরও সেই দিনের একটি মুহূর্তও বিস্মৃত হন নাই পঞ্চাশোর্ধ এই বৃদ্ধা।
তিনি বলেন, রোববার (৪ আগস্ট, ২০২৪) সকালে সুমন বাপের দোকানে যাইয়্যা ১০ ট্যাহা নেয়। ওর বাপে বাজার কইর্যা দেয়। বাজার নিয়্যা যহন বাড়িত আইসে তহন আমি ঘুমাইয়্যা আছিলাম। আমাক তিনবার ডাক দেয়। কিন্তু এমন ঘুম ঘুমাইছিলাম, বাবার ডাক আমার কানে পৌঁছাই নাই। কিছুক্ষণ পর ভয়ংকর স্বপ্ন দেইহ্যা আমার ঘুম ভাইঙ্যা যায়। বিছানা থিক্যা উইঠ্যা বাইরে আইস্যা দাঁড়াইচি, তহনই আমার ভাস্তি আইস্যা খবর দিলো সুমন ভাইয়ের গুলি লাগছে। আমি হাঁউ মাঁউ করে কান্দি আর কই, ভালো অইচে, বেটা আমাগোরে কুন কথা হোনে না। দৌড়াইয়া হাসপাতালে যাই, আল্লার কাছে কই, আমার বাবার প্রাণ ভিক্ষা দাও। কিন্তু যাইয়্যা দেহি, ব্যাটা আর নাই। কত মানুষ আমার বাবাকে ঘির্যা নিয়্যা কানতাছে। আমার বাবার শ্যাষ ডাকও শুনি নাই।
ফিরোজা বেগম আরও বলেন, সুমন বাড়ির সবাইকেই খুব ভালোবাসত। আমার গলা ধইর্যা কত কথাই কইতো। প্রতি রাইতে ব্যাটার জন্য আমিও কান্দি ওর বাপেও কান্দে। ব্যাটার শোকে বাপটা অসুস্থ হইয়্যা পইড়চে। সুমন সংসারে সহযোগিতার জন্য ইন্টারনেট লাইনে চাকরি করত। যা আয় করতো আমার কাছে এনে দিত। ব্যাটা আমার চইল্যা গেল, ট্যাহা-পয়সা মেলা পাইলাম। কিন্তু ব্যাটা তো নাই।
সুমনের পরিবার জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ, বিএনপি দেড় লাখ, জামায়াত, ২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। এছাড়াও ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র, দুইটা গরু ও একটা অটোরিকশা পেয়েছে তার পরিবার।
ছাত্রদল কর্মী সুমন ১৯৯৩ সালের ২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ শহরের গয়লা দক্ষিণপাড়া মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গনজের আলী (৫৯) চা বিক্রেতা। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সুমন দ্বিতীয়। চায়ের দোকানই ছিল তাদের পরিবারের আয়ের উৎস। সংসারের অভাব দূর করতে সুমন পড়াশোনার পাশাপাশি ব্রডব্র্যান্ডের কোম্পানিতে কাজ করতেন। সিরাজগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি (কারিগরি) পাস করার পর সুনামগঞ্জ পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ পেলেও সেখানে ভর্তি হয়নি।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে সিরাজগঞ্জ শহরে ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নেন সুমন। মিছিলটি ইলিয়ট ব্রিজের পশ্চিমে গেলে যুবলীগ নেতাকর্মীরা গুলি ছুড়তে থাকে। সুমনের বুকের পাঁজরের নিচে তিনটি গুলি লাগে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বাবা গনজের আলী বলেন, সুমনকে হারিয়ে সংসারের হাল ধরার খুঁটিটাই হারিয়ে ফেলেছি। সংসার চালাতে ও আমাকে খুব সহযোগিতা করত। ৪ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সকালে ১০ টাকা নিয়ে যায় সুমন। আমাকে না জানিয়েই যোগ দিয়েছিল মিছিলে। ১১টায় খবর এলো সুমনের গুলি লেগেছে। এসময় সুমনের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন তিনি।
ভাইয়ের স্মৃতি মনে করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না সুমনের ছোট বোন আদুরী খাতুন। আদুরী বলেন, সুমন ভাই আমাকে খুব ভালোবাসত। শাসনের মধ্যে রেখেছে, আদরও করেছে। পিঠাপিঠি ভাইবোন ছিলাম, তাই খুনসুটিও হতো। আমাদের পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো না, টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে দুজন পড়াশোনা করতাম। আমার খরচ চালানোর জন্য নিজে সেক্রিফাইস করছে। ও ভালো জায়গায় চান্স পেয়েও ভর্তি হয়নি। বলেছিল, আমি যদি ভালো জায়গায় পড়াশোনা করি, তাইলে বোনের পড়াশোনা হবে না। পার্ট টাইম কাজ করেছে আর পড়াশোনা করেছে। আমার বড় ভাই ফরিদুলের শারীরিক সমস্যা আছে। সে রোজগার করে না। বাবাও অসুস্থ। অসুস্থতার মধ্যে সে দোকান করে। এখন আমার একটা চাকরি হলে ভালো হতো।
৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব ইদ্রিস আলী সরকার বলেন, সুমন ছেলেটা কোনো উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল না। কখনো কারও সঙ্গে মারামারি ও তর্কবিতর্ক হয় নাই। তবে নিজের তাগিদ থেকে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করার আন্দোলনে অংশ নেয়। আর মিছিলে গিয়েই সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারায়।
সুমন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শরিফুল ইসলাম জানান, এ মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবুসহ বেশ কিছু আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মামলার তদন্তকাজ এগিয়ে চলছে বলেও জানান তিনি।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, সুমন ছাত্রদলের একজন নিবেদিত কর্মী ছিল। সে দারিদ্রতার কাছে হার মানে নাই। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে বাবার সংসারে সহযোগিতা করেছে। ৪ আগস্ট স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের মিছিলে অংশ নেয় সুমন। ওই মিছিলে আমিও ছিলাম। ইলিয়ট ব্রিজের কাছে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় সুমন। সুমনসহ সিরাজগঞ্জে নিহত ১১ জন শহীদের হত্যার বিচার দাবি করছি।
আরএ