কলকাতা: ‘হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুদিন আগে তিনি আমাকে ফোনে বলেছিলেন, আমি ২ মে ঢাকায় যাব। আমি বলেছিলাম, সে সময় আমি দেশের বাইরে থাকব, আপনি ৪ তারিখের পরে আসুন।
রোববার (২১ মে) সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মরণ সভায় এসব কথা বলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম।
গত ৮ মে বিকেলে কলকাতার অ্যাপলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। পরদিন নিমতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। রোববার দক্ষিণ কলকাতার জিডি বিড়লা সভাঘরে অনুষ্ঠিত হলো সমরেশ মজুমদারের স্মরণসভা।
কথাসাহিত্য সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিচারণ করে নঈম নিজাম বলেন, তিনি যখনই ঢাকায় যেতেন আমার অফিসে একবার আসতেন। আমার প্রতি তার একটা অপরিসীম স্নেহ, ভালোবাসা ছিল। বাংলাদেশ প্রতিদিনে নিয়মিত লিখতেন। এরকম একজন ব্যক্তির সান্নিধ্য আজ আমি খুব অনুভব করছি। আমি ওনাকে খুব মিস করছি। বাংলাদেশের মানুষ তাকে মিস করছে।
‘নিউইয়র্কের হাডসন থেকে মেঘনা, তার সাথে ঘুরে বেড়াতাম, তার সঙ্গী হয়ে। যা আমার চিরকাল স্মরণে থাকবে। তিনি সকলের সাথে মিশে যেতে পারতেন। তিনি ‘অনুপ্রবেশ’ নামে একটি বই আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন, যা আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। স্মৃতি হয়ে থাকবে। শরৎচন্দ্র, সমরেশ মজুমদার, হুমাযূন আহমেদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এনারা সকলেই দুই বাংলার সম্পদ। ’
স্মরণসভায় আরও উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, লেখক সঞ্চীব চট্টোপাধ্যায়, লেখক প্রচেত গুপ্ত, সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা রণজিত মল্লিক, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দুলাল লাহিড়ি, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, নাট্যব্যক্তিত্ব খেয়ালি দোস্তিদার, অভিনেতা-পরিচালক গৌতম ঘোষ, বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাটার্য্য, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআইএম নেত্রী রমলা চক্রবর্তী, বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস, প্রেস সচিব রঞ্জন সেন, লেখক রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন ইন্দো-বাংলা প্রেসক্লাবের সদস্যরা।
সমরেশ মজুমদারের মেয়ে দোয়েল মজুমদার বলেন, বাবার হৃদয়ে সব সময় বাংলাদেশ ছিল। ভীষণ পছন্দ করতেন বাংলাদেশের মানুষকে। বাবার বাংলাদেশের মিষ্টি অত্যন্ত প্রিয় ছিল। বাংলাদেশের মানুষের আত্মীয়তা এবং আতিথেয়তার কোনো তুলনা হয় না। এটা একমাত্র পৃথিবীতে ওই দেশেই পাওয়া যায়। আমাদের ভাষা তো এক। যার ফলে বাবার কাছে সব সময় বাংলাদেশ প্রিয় ছিল।
অভিনেতা রণজিত মল্লিক বলেন, সমরেশ মজুমদারের সাথে পরিচয় আমার দীর্ঘদিনের। প্রায় ৩৫-৩৬ বছর হয়ে গেল। আমার সাথে প্রথম যোগাযোগ ‘নজরবন্দী’ ছবির মধ্যে দিয়ে। কাজের কারণে একসাথে উত্তরবঙ্গের চা বাগানে কাটিয়েছিলাম। এছাড়া তার অসামান্য নাটক ‘তিন নম্বর চোখ’ এর জন্য একসাথে আমেরিকা, কানাডা, লন্ডনে বহুদিন কাটিয়েছিলাম। বহু স্টেজ শো হয়েছিল। অনেকেই জানেন না সেখানে উনি অভিনয়ও করেছিলেন। অত্যন্ত সজ্জন, ভদ্রলোক, রুচিসম্মত একজন মানুষ সমরেশ মজুমদার। তিনি ছিলেন আমাদের আড্ডার মধ্যমণি।
পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, সমরেশ দা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু, অসংখ্য বাঙালি পাঠকের মনে চিরকাল রয়ে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, নর্থ আমেরিকা সর্বত্র তাঁর জনপ্রিয়তা অতুলনীয়। অসংখ্য মানুষের স্মৃতিতে থেকে থেকে যাবেন সমরেশদা। আমার এত খারাপ লাগে, শেষবার দাদার আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল। আমাকে বলেছিল, তুই যদি যাস আমিও যাব। তাঁর আর যাওয়া হলো না। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সমরেশ মজুমদারকে সব সময় মনে রাখবে।
টলিউড অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, আমি অনেক ছোটবেলা থেকে সমরেশদাকে চিনতাম। আমাদের পরিবারের সাথে বিশেষ করে আমার মায়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। প্রায় উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমিও ওনার সাথে যোগাযোগ রেখে চলতাম। সমরেশদার বেশ কিছু গল্প নিয়ে আমি কাজ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু, কোনভাবে তার জীবনকালে সেটা করে ওঠা হয়নি। খুব শিগগিরই তাঁর গোয়েন্দা গল্প অর্জুন পর্দায় আসতে চলেছে। গর্ভধারিনী থেকে শুরু করে যেসব লেখা তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, সেটা আমাদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ।
কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, সমরেশের লেখালেখি শুরু করলো এবং অল্প দিনের মধ্যেই এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল, যেটা সত্যিই বিস্ময়কর। তার লেখা পড়লে বোঝা যেত কত সহজে সে মানুষের সাথে কমিউনিকেট করতে পারে। আসলে সাহিত্য তো তার কিছুই নয়, আসল বিষয় হলো কমিউনিকেশন। একটা মন থেকে আর একটা মন অভিধাবন। এটাই হচ্ছে সাহিত্য- আর এই কাজে সে দক্ষ ছিল। এত সহজ ভাষায় গল্প বুনতে পারতেন, যার কারণে তার সৃষ্টি মানুষের মনে ঢেউ তুলতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমাকে দাদা বলে ডাকত। আমিও তাকে বাবলু বলে ডাকতাম। গত কয়েক বছর তার সাথে খুব একটা দেখা হতো না। শেষের দিকে আমাদের যোগাযোগটা টেলিফোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। ও আমাকে বলতো, বাবলু বলে ডাকার লোক এখন একমাত্র তুমিই আছ। একটা অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। ব্যক্তি সমরেশ আমার কাছে এক অদ্ভুত মানুষ। একজন প্রাণচঞ্চল মানুষ। মাত্র ৭৯ বছর বয়সে চলে গেল। ওর থেকে আমার বয়স বেশি। আমি বেঁচে আছি। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিছুদিন আরও থাকতে পারত, লিখতে পারত। আমারও বাবলু বলে ডাকার একজন লোক থাকত।
মুগ্ধ হয়ে গুণীজনদের এসব বক্তব্য শুনতে থাকেন দর্শকরা। আর তখন দেখা গেল নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সাহিত্যিকের দুই মেয়ে দোয়েল আর পরমা। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সমরেশের পুত্রসম শুভদীপ রায়। হিন্দুমতে সমরেশের অন্ত্যেষ্টি এই শুভদীপই করেছিলেন। তাদের অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছিল, সকলের সাহিত্যিক হলেও আসলে তাদের বাবা সমরেশ মজুমদার।
‘মন খারাপ লাগছে! জানেন তো আমরা একবার উত্তরবঙ্গ যাচ্ছি, ট্রেনের জানলার ধারে বসে বাবা গাইছেন, শান্ত নদীটি পটে আঁকা...। বাবা বলে উঠলেন, আমার সাথে একটু গাও না। ’ এরপরই সমরেশ মজুমদারের ছবির দিকে তাকিয়ে মৃদস্বরে দোয়েল গেয়ে উঠলেন, শান্ত নদীটি পটে আঁকা...।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২৩
ভিএস/এমজেএফ