কলকাতা: চলতি বছরের শেষদিকে ভারতের গুজরাটে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। আগামী ১ ডিসেম্বর এবং ৫ ডিসেম্বর সেখানে ভোটগ্রহণ করা হবে।
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ১৬ নম্বর ধারা ও ২০০৯ সালের নিয়ম অনুসারে, এই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে ৬ নং ধারা অনুযায়ী নাগরিকরা প্রশংসাপত্র পাবেন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সংখ্যালঘু অ-মুসলমান অর্থাৎ ৬ সম্প্রদায়ের মানুষ- হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি এবং খ্রিস্টান যারা ভারতের গুজরাট রাজ্যের আনন্দ এবং মেহসানা জেলায় বসবাস করছেন, তাদের ওই দুই জেলার কালেক্টরা নাগরিকত্ব দেবেন।
কেন্দ্রের ওই ঘোষণার পর আইন বাস্তবায়নের দাবিতে ভারতের অন্যান্য স্থানেও ঝড় উঠেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকার মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে- এই দাবি তুলে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশ কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছে। তাদের বক্তব্য গুজরাটে এই আইনে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও পশ্চিমবঙ্গে কেন তা হচ্ছে না?
পশ্চিমবঙ্গের হরিণঘাটার বিধায়ক ও সঙ্গীতশিল্পী অসীম সরকার জানান, ১৯৫৫ সালের আইন অনুযায়ী, গুজরাটে খাতা খোলা হয়েছে। এরপর বাংলায় খাতা খোলা হবে। বাংলাদেশসহ তিন দেশ থেকে চলে আসা সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এনিয়ে গানও শোনান তিনি। ‘দিদিমণি (মমতা) বুঝবে কি / ওই সিএএ মমতা/ আল কায়দা আর জামাত ইসলাম/ ওটাই ওনার মূল ক্ষমতা। ’
রাজ্যের শাসক দলসহ বিরোধী দলগুলিকে নিশানা করে অসীম সরকারের অভিযোগ, মমতার সঙ্গে সিপিএম ও কংগ্রেস চাইছে আলকায়দা, রোহিঙ্গা এবং জামাতি যারা ভারতে প্রবেশ করে দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করতে চাইছে, তারাও নাগরিকত্ব পাক। আসলে ওরা চাইছে ভোটের তাস খেলতে। পাশাপাশি বিজেপি বিধায়ক জানান, কোনো মুখ্যমন্ত্রী এটাতে বাধা দিতে পারেন না। কারণ তিনি সাংবিধানিক প্রধান। তাই এটার বিরোধিতা করা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই নয়।
যদিও তার আশঙ্কা ২০২৪ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বাস্তবায়িত না হলে রাজ্যের মতুয়া সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর থেকে আস্থা উঠে যেতে পারে। আমার মনে হয়, ২০১৯ সালে বিজেপি যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা তারা রক্ষা করবে। কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হলে বিজেপির ওপর মতুয়াদের বিশ্বাস থমকে দাঁড়াবে।
পাশপাশি মোদি সরকারকে তার প্রশ্ন, যদি ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া যায়, তাহলে ২০১৯ সালে ওই নতুন সংশোধিত আইন করার দরকার কী ছিল? আমি মনে করি এ বিষয়টা কেন্দ্রীয় সরকারের স্পষ্ট করা উচিত।
নতুন নির্দেশিকা জারির বিষয়ে, মতুয়া মহাসঙ্ঘের নেতা তথা বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ, কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর জানান, বিজেপি ‘সিএএ’ কার্যকর করার জন্য দায়বদ্ধ। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্টে ‘সিএএ’ নিয়ে আড়াই শতাধিক মামলা হয়েছে। যারা এই আইন চায় না, তারাই এই মামলাগুলি করেছে। সেক্ষেত্রে এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলেই এই আইন চালু হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, তাছাড়া ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্য সরকারের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু গুজরাট ও কেন্দ্রে একই সরকার ক্ষমতায় থাকায় এই নির্দেশ কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে। তবে আমরা আনন্দিত এবং আশাবাদী আগামীতে পুরো ভারতের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও নতুন নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বিশাল সংখ্যক মতুয়া সম্প্রদায় ভারতে চলে আসে। পশ্চিমবঙ্গের ৬টি সংসদীয় কেন্দ্র ও ২৬টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়াদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ এই কেন্দ্রগুলিতে তারাই ভোট নির্ধারকের কাজ করে। গোটা রাজ্যে ঠিক কী পরিমাণ মতুয়া ভোটার রয়েছে তার কোনো সরকারি তথ্য জানা না গেলেও বিভিন্ন সূত্র মারফত ধারণা করা হয়, পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া ভোটারের মোট সংখ্যা ২ কোটির কাছাকাছি।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে নাগরিকত্বের ইস্যু তুলে পশ্চিমবঙ্গে মতুয়াদের পাশে পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এরপর নানা কারণে এই আইন বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় তাদের মধ্যে বেশ কিছুটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এমনকী, বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটিতে মতুয়া প্রতিনিধি না থাকায় গত বছরের শেষদিকে বিজেপির সামাজিক গ্রুপ ত্যাগ করে মুকুটমণি অধিকারী, সুব্রত ঠাকুর, অসীম সরকারসহ ৫ বিজেপি বিধায়ক। বিজেপির বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপ থেকে বেরিয়ে আসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও। বিষয়টি নিয়ে এসে সময় প্রচণ্ড শোরগোল পড়ে যায়।
এমনকী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যে সফরে এসে আশ্বাস দেন কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সিএএ কার্য়কর হবে। চলতি বছরের মে মাসে শিলিগুড়িতে এসে এই ইস্যুতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করে তিনি বলেন, মমতা দিদি আপনি তো এটাই চান যে, অনুপ্রবেশ জারি থাকুক এবং বাংলাদেশ থেকে যে শরণার্থীরা এসেছেন তারা নাগরিকত্ব না পান। কিন্তু তৃণমূলের লোকেরা কান খুলে শুনে নিন, সিএএ বাস্তবায়ন ছিল, আছে এবং থাকবে। মমতা দিদি, আপনি কিছুই করতে পারবেন না।
যদিও প্রথম থেকে সিএএ'র বিরোধিতা করে আসছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস। দলের প্রধান তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, ‘আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি, আমরা সিএএ কার্যকর করতে দেব না। আমরা আমাদের আগের অবস্থানেই অনড় আছি। গুজরাট নির্বাচনের আগে এটা চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের কাছে রাজনৈতিক স্টান্টের চেয়ে মানুষের জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন তৃণমূলের সাবেক সংসদ সদস্য ও মতুয়া সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেত্রী মমতা বালা ঠাকুর। এর পেছনে ভোটের রাজনীতি দেখছেন তিনি। তার অভিমত, গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দাবি নিঃশর্ত নাগরিকত্ব। কী প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা পরিষ্কার নই। সেটা জানার পরই আমরা সঠিকভাবে বলতে পারব।
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ফের এই ইস্যুটিকে জাগিয়ে তুলতে চাইছে।
বাংলাদেশ সময়: ০১২২ ঘণ্টা, ৭ নভেম্বর, ২০২২
ভিএস/এমএমজেড