১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজাসহ কিছু ভূখণ্ড ইসরায়েল দখল করে। সেসব ভূখণ্ডে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক নাগরিকদের বসবাসের স্থানকেই বলা হয় ‘বসতি’।
ইসরায়েলের ৭০ লাখ ইহুদি জনসংখ্যার ১০ শতাংশ অর্থাৎ সাত লাখেরও বেশি বসতি স্থাপনকারী এখন অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের ১৫০টি বসতি ও ১২৮টি ফাঁড়িতে বাস করে।
এসব বসতির বেশ কয়েকটিতে হাজার হাজার ইসরায়েলির বাস। সেগুলোকে শহরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আবার ভাঙাচোরা জোড়াতালি দেওয়া ফাঁড়ির মতো বসতিও আছে, যেগুলোর অনুমোদনই নেই। তবে ইসরায়েলিদের এসব বসতিই ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের ইতিহাস
১৮০০ সালের শেষের দিকে থেকে ২০ শতকের শুরুতে যখন জায়নবাদের সূচনা হয়, তখন ইউরোপে ইহুদি-বিদ্বেষও বাড়তে থাকে। তখন পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনও শুরু হয়।
ফলে প্রাচীন ফিলিস্তিনে ইহুদি জনসংখ্যা ১৮৮২ সালে প্রায় ২৪ হাজার থেকে বেড়ে ১৯৪৮ সালে ছয় লাখ হয়ে যায়। ওই ইহুদিরা মূলত নতুন প্রতিষ্ঠিত কৃষি স্থাপনা এবং খামারে বাস করত, যাকে তারা ‘কিবুতজিম’ বলে থাকে।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা প্রাচীন ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণার পর আরব ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধের ঠিক আগে এবং যুদ্ধ চলাকালে সাত লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে নিষ্ঠুরভাবে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল। সেই ঘটনাকে ‘নাকবা’ বলা হয়। যুদ্ধের সময় ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং পশ্চিম তীরে অবস্থিত কেফার এটজিয়ন বসতির মতো আরও কিছু ইহুদি বসতিতে আরব সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় এবং সেগুলো জনশূন্য করে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের অধীনে অবৈধ হওয়ার পরও কেফার এটজিওন ছিল ইসরায়েলি সরকারের আবারও প্রতিষ্ঠা করা প্রথম বসতি। বর্তমানে সেখানে এক হাজার ৩০০ মানুষ বাস করে। ১৯৬৭ সালে কেফার এটজিওন আবার প্রতিষ্ঠা করার পর ব্যাঙের ছাতার মতো আরও ইসরায়েলি বসতি গজিয়ে উঠতে থাকে।
ইসরায়েলের সরকারি বসতি নীতি
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের এক বছর পর সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে ছয়টি ইসরায়েলি বসতি স্থাপন করা হয়। ১৯৭৩ সালের মধ্যে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে ১৭টি এবং গাজা উপত্যকায় সাতটি বসতি স্থাপন করে। ১৯৭৭ সালের মধ্যে প্রায় ১১ হাজার ইসরায়েলি পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, গোলান মালভূমি ও সিনাই উপদ্বীপে বাস করত।
৭০ ও ৮০’র দশকজুড়ে ধারাবাহিক ইসরায়েলি সরকারের অধীনে বসতি নির্মাণে গতি আসে। সরকার ইসরায়েলিদের ওইসব অঞ্চলে বাস করতে উৎসাহ দিতে আবাসন এবং অবকাঠামোর জন্য ভর্তুকির মতো প্রণোদনা দিয়েছে।
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সই হওয়ার সময় পশ্চিম তীরের ১২৮টি বসতিতে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার এবং পূর্ব জেরুজালেমের ১২টি বসতিতে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বসতি স্থাপনকারী ছিল। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েল ও প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অরগানাইজেশন— পিএলওর মধ্যে অসলো চুক্তি সই হয়।
অধিকৃত পশ্চিম তীরকে এ, বি ও সি— তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নতুন বসতি নির্মাণ বন্ধ করতে ইসরায়েল সম্মত হয়েছিল। তারপরও বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত ছিল।
এক বছর পর ১৯৯৪ সালে অধিকৃত পশ্চিম তীরে বৃহত্তম বসতি মোদিন ইলিট প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে ৮৩ হাজার বসতি স্থাপনকারীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তাদের বেশিরভাগই অতিগোঁড়া ইহুদি। বসতিটির নিজস্ব মেয়র, স্কুল এবং চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। এনজিওগুলোর ক্ষোভ সত্ত্বেও ২০১৮ সালে বসতিটিকে শহরের মর্যাদা দেওয়া হয়।
অসলো চুক্তির পর থেকে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা স্বাধীনভাবে ছিটমহল তৈরি করেছে। সেগুলো ফাঁড়ি নামে পরিচিত। ফাঁড়িগুলো সরকারের অনুমোদিত নয়। অনেক সময়ই সেগুলো ক্যারাভানের মতো ভ্রাম্যমাণ ঘর নিয়ে গড়ে উঠতো।
অন্য বসতিগুলো আরও উন্নত। সেগুলোতে পাকা রাস্তা এবং ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগ রয়েছে। যদিও ইসরায়েল ফাঁড়িকে অবৈধ বলে মনে করে, কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ সেগুলো প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী প্রায়ই সেগুলোকে সুরক্ষা দেয়।
২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ১০টি ফাঁড়িকে বৈধতা দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় ফাঁড়িগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে প্রায় ৪০০ মানুষের থাকার ব্যবস্থা ছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীরা কমপক্ষে ১৫টি ফাঁড়ি এবং ১৮টি রাস্তা তৈরি করেছে। অসলো চুক্তির পর থেকে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি পশ্চিম তীরের ৪২ শতাংশ জমি দখল করেছে। পূর্ব জেরুজালেমের ৩৫ শতাংশ জমি বসতি এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো দিয়ে দখল করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের জীবনে ইসরায়েলিদের বসতি কী প্রভাব ফেলছে
বসতি স্থাপনের জন্য সহায়ক অবকাঠামোরও প্রয়োজন। বসতি স্থাপনকারীদের জন্য ইসরায়েলে এবং বসতি থেকে বসতিতে যাতায়াতের রাস্তা, পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ গ্রিডও স্থাপন করা হয়েছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বাইপাস রোড নেটওয়ার্ক বসতিগুলোকে পরস্পর এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করে।
কিন্তু এসবের কারণে ফিলিস্তিনি এলাকাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলিদের এসব কার্যকলাপ ফিলিস্তিনিদের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে, তাদের চলাফেরা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। পশ্চিম তীরজুড়ে ১৪০টি চেকপয়েন্টসহ ৭০০টি রাস্তার বাধা থাকায় ফিলিস্তিনি যানবাহনগুলো তুলনামূলক দীর্ঘ আর অপ্রধান রাস্তা ধরে চলতে বাধ্য করে। কারণ রাস্তাগুলোতে বসতি স্থাপনকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
ইসরায়েলের সীমানা বেষ্টনী পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে গেছে। এটি ১৯৬৭ সালের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা বরাবর নয়। এটি ৩০ লক্ষেরও বেশি ফিলিস্তিনিদের চলাচলকে সীমাবদ্ধ করছে। যেমন, কৃষকেরা বছরে মাত্র দুইবার বসতির কাছাকাছি তাদের কৃষিজমিতে যেতে পারে। তার জন্যেও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগে অনুমোদন নিতে হয়। এই বিষয়ে ইসরায়েলের বক্তব্য হলো, নিরাপত্তার কারণে এমন বিধিনিষেধ প্রয়োজন। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের এমন নীতিগুলোকে ‘বর্ণবাদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইসরায়েল পশ্চিম তীরের প্রায় ২৫ শতাংশ ভূখণ্ডকে ‘রাষ্ট্রীয় ভূমি’ করে নিয়েছে। এর অর্থ হলো জমিটি প্রায় একচেটিয়াভাবে ইহুদি বসতি স্থাপনে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে ফিলিস্তিনিদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে থাকে।
বসতি স্থাপনকারীদের জন্য জায়গা তৈরি করতে তারা ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি দখল এবং ধ্বংস করে থাকে। ইসরায়েলের যুক্তি, ফিলিস্তিনি সম্পত্তিতে ইসরায়েলের ইস্যু করা কোনো বিল্ডিং পারমিট এবং জমির নথিপত্র নেই। এই পারমিট পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের তাদের নিজস্ব বাড়িঘর ধ্বংস করতে বাধ্য করে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়ন করা নীতি অথবা ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার কারণে ২০২৩ সালে চার হাজার ফিলিস্তিনিকে অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে ঘরছাড়া করা হয়েছিল। তাদের বাড়িঘর, দাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত স্কুল, কৃষি অবকাঠামো ও মানবিক সহায়তা সরবরাহকারী অন্যান্য স্থাপনাসহ শত শত ফিলিস্তিনি কাঠামো ইসরায়েল ধ্বংস করেছে বা জব্দ করেছে।
বসতি বাড়ানোর জন্য ইসরায়েলি সরকারের জমি ক্রোক করা এবং বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলি গোষ্ঠীর দখলবাজির ফলে ফিলিস্তিনিরা তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান কমে যায়। সেচ, কৃষিকাজ এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত পানির উৎসের অভাব গ্রামীণ ফিলিস্তিনি মানুষদের মারাত্মক বিপদে ফেলে। তারা ঝুঁকিতে পড়েন এবং তাদের মানবিক সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
অনেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইসরায়েলি বসতি থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য, মানুষের মলমূত্র ও পশুর বর্জ্য ফিলিস্তিনি কৃষিজমিতে ফেলা হয়। এসব আবর্জনা জমিগুলোকে ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেলে।
১৯৯৩ সাল থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তা প্রায় সাত লাখে পৌঁছে। ২০৪৬ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছাতে পারে। বসতি স্থাপনকারীরা যত বাড়ে, ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে হামলাও বাড়তে থাকে।
বসতি স্থাপনকারীদের ঘন ঘন সহিংসতার কারণে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরায়েলিদের ওইসব সহিংসতার মধ্যে রয়েছে আক্রমণ, ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তি, গাছ বা ফসলের ক্ষতি ও গ্রামে অভিযান। আক্রমণগুলো প্রায়শই ইসরায়েলি সৈন্যদের জানিয়েই করা হয়। তারা আক্রমণকারীদেরই রক্ষা করে। বছরের পর বছর ধরে এমন আচরণ বেড়েছে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দেশ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলে মনে করে। বিশেষ করে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন দখলদার শক্তিকে তার বেসামরিক জনগণকে তাদের দখলকৃত অঞ্চলে স্থানান্তর করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জাতিসংঘ অসংখ্য প্রস্তাবের মাধ্যমে বসতি স্থাপনের নিন্দা করেছে।
২০১৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, বসতিগুলোর কোনো আইনি বৈধতা নেই। ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং নিরাপত্তার কারণ উল্লেখপূর্বক ইসরায়েল সেই ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জাতিসংঘে প্রায়ই তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে ইসরায়েলকে কূটনৈতিক নিন্দা থেকে রক্ষা করে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দিয়েছেন যে বসতি স্থাপন শান্তি প্রক্রিয়ার একটি বড় বাধা। ওই তৎপরতা অধিকৃত পশ্চিম তীরকে টুকরো টুকরো করে এবং ফিলিস্তিনিদের জীবনকে গভীর কষ্টে ফেলে। বসতি নির্মাণ বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। তারপরও ইসরায়েলের অতি-ডানপন্থী সরকার কখনো কখনো জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সহযোগিতা করে বসতি বাড়ানোকে সমর্থন করে চলেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের সরকার পূর্ব জেরুজালেমে বসতি নির্মাণ প্রকল্পে গতি এনেছে। অসলো চুক্তির পর এবারই সবচেয়ে বড় ভূমি দখল শুরু করেছে। এতে জর্দান উপত্যকায় ১২ দশমিক ৭ বর্গকিলোমিটার জমি দখল করা হয়েছে। একদিকে ইসরায়েলি বসতি বাড়ছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণ, তাদের সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিকে যেভাবে কোণঠাসা করা হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সামান্য আশাও হারিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৫
আরএইচ