ঢাকা, বুধবার, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৪ জুন ২০২৫, ০৭ জিলহজ ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সীমান্তে মিয়ানমারের ১০ বিদ্রোহী নিহত, ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ধাক্কা

আন্তজার্তিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:১৮, জুন ২, ২০২৫
সীমান্তে মিয়ানমারের ১০ বিদ্রোহী নিহত, ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ধাক্কা

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী তামু জেলার কাছে গত ১৪ মে ভারতীয় সেনাবাহিনী মিয়ানমারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিকেপি)-এর ১০ জন সদস্যকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে তিনজন কিশোর ছিল। পিকেপি হচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের নির্বাসিত সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)-এর অধীনস্থ একটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী।

ভারতের আসাম রাইফেলস দাবি করে, এই যোদ্ধারা সশস্ত্র বিদ্রোহী এবং অবৈধ সীমান্ত পারাপারে জড়িত ছিল। তবে এনইউজি এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানায়, নিহতদের ভারতের ভেতরেই আটক ও বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এই ঘটনায় ভারতীয় বাহিনী ও মিয়ানমারের প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের এক অনানুষ্ঠানিক বোঝাপড়া ভেঙে যায়, যে  বোঝাপড়া মাধ্যমে তারা একে অপরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। এ ঘটনায় উত্তর-পূর্ব ভারতে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের শরণার্থী ও যোদ্ধাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা, যা শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা জাতিগত ও সামাজিক সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করছে।

পুরোনো ঘাঁটির অবস্থান মিয়ানমার সেনাবাহিনী জেনে গত ১২ মে  পিকেপি-র দশজন সদস্য তামুর একটি নতুন ক্যাম্পে পৌঁছায়। স্থানীয় সূত্র ও একজন এনইউজি কর্মকর্তার মতে, এই নতুন ক্যাম্পের তথ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আগেই জানানো হয়েছিল এবং ১২ তারিখে আসাম রাইফেলস ক্যাম্প পরিদর্শনও করেছিল।

তবে পরবর্তী ঘটনাগুলো নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। ১৪ মে, ভারতীয় সেনাবাহিনী দাবি করে, তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানে যায় এবং চান্ডেল জেলার নিউ সামতাল এলাকায় পিকেপি সদস্যদের গুলির মুখে পড়ে, পরে পাল্টা গুলিতে ১০ জন নিহত হয়। ১৬ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তারা সাতটি একে-৪৭ এবং একটি রকেট লঞ্চার উদ্ধার করেছে। ২১ মে তারা নিহতদের পিকেপি সদস্য হিসেবে নিশ্চিত করে এবং দাবি করে যে এই হামলা চলমান সীমান্ত বেড়া নির্মাণ কাজে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।

বিশ্লেষক ও একজন সাবেক ভারতীয় কর্মকর্তা এসব বিবৃতির অসামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—অভিযানটি কি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পূর্বপরিকল্পিত ছিল, নাকি হঠাৎ আক্রমণের প্রতিক্রিয়া ছিল? এটা "যুদ্ধের ধোঁয়াশা"র মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি ভুলও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মিয়ানমারের এক পিডিএফ কর্মকর্তা বলেন, নিহত পিকেপি সদস্যরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত বা সজ্জিত ছিল না যাতে তারা ভারতের পেশাদার সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হতে পারে।

১৬ মে, যখন নিহতদের খবর জানানো হয়, তখন তামু জেলার স্থানীয় কর্মকর্তারা মৃতদেহ গ্রহণ করতে ভারতে প্রবেশ করেন। একজন কর্মকর্তার মতে, আসাম রাইফেলস আগেই কিছু নথি প্রস্তুত রেখেছিল এবং এই নথিগুলোতে স্বাক্ষর না করলে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে না বলে হুমকি দেয়। এসব নথিতে ঘটনাটি ভারতীয় ভূখণ্ডে সংঘটিত হওয়া ও সীমান্ত বেড়া নির্মাণে সম্মতির কথা লেখা ছিল।

তামুর পিপলস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন টিমের প্রতিনিধি থিদা এবং এনইউজি কর্মকর্তারা বলেন, তারা এক মাস ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করে আসছেন যেন তারা সীমান্ত বেড়ার কাজ স্থগিত করে এবং এনইউজি-র সঙ্গে বৈঠকে বসে। এই অনুরোধগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে।

ঘটনায় হতবাক থিদা বলেন, আমরা তো আমাদের দেশেই বিদ্রোহী—আমরা কিভাবে ভারতের মতো বড় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করব? তিনি আরও বলেন, মৃতদেহগুলোর অবস্থা ছিল ভয়াবহ; তাদের শরীরে পোকা ধরেছিল। তিনি ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মৃতদের প্রতি কোনো সম্মান না দেখানোর অভিযোগও তোলেন।

মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে গবেষণা করা অঙ্গশুমান চৌধুরী বলেন, পিকেপি যোদ্ধাদের হত্যা ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত’। তিনি বলেন, মূল বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হলো সীমান্তে বেড়া দেওয়া। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তের উভয়পারে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিকভাবে মুক্তভাবে যাতায়াত করত, যা সীমান্তভিত্তিক মানচিত্র গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এখন এই বেড়া সেই ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং এমন সব আতঙ্ক তৈরি করছে যা আগে কখনও ছিল না।

ভারত গত বছর ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ বাতিল করে সীমান্তে বেড়া নির্মাণ শুরু করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, এটি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা’ ও ‘জনগোষ্ঠীগত কাঠামো’ রক্ষায় জরুরি। কিন্তু সমালোচকরা মনে করেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বিশেষত বিজেপি সরকার ও মণিপুর রাজ্য সরকার মেইতেই জনগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা অভিবাসীদের দোষারোপ করে তারা বলছে, এই অভিবাসীরা রাজ্যের জাতিগত সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে।  

এখন, তামুর এই হত্যাকাণ্ড সীমান্তে এক নতুন উত্তেজনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যেখানে এতদিন ভারতীয় বাহিনী ও মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করত। চৌধুরী সতর্ক করে বলেন, মনে রাখতে হবে, অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও এই ঘটনাগুলো মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে—এগুলো দ্রুত বিস্ফোরক পরিস্থিতিতে রূপ নিতে পারে।

এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।