দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কে ‘অটুট বন্ধুত্বের’ ছবি দেখেছে বিশ্ব। রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন বারবারই জানিয়েছেন, চীনের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
বন্ধুত্বের মুখোশে গুপ্তচরবৃত্তির খেলা?
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পরপরই, চীনা প্রতিরক্ষা এবং গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিপুল সংখ্যায় রাশিয়ায় প্রবেশ করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য সংগ্রহ। বিশেষ করে, পশ্চিমা অস্ত্র এবং প্রযুক্তির বিরুদ্ধে রাশিয়া কীভাবে প্রতিরোধ গড়ছে, তা জানতেই চীনের এত উৎসাহ।
এফএসবির তথ্যমতে, চীন ড্রোন প্রযুক্তি, সফটওয়্যার উন্নয়ন, ও আধুনিক যুদ্ধ কৌশল জানার জন্য রুশ বিজ্ঞানীদের টার্গেট করছে। রুশ সামরিক পাইলট, অ্যারোহাইড্রোডাইনামিকস ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাতা বিশেষজ্ঞদেরও চীন নানাভাবে আকর্ষণ করছে। তবে এসব নিয়োগের উদ্দেশ্য গবেষণা, না কি গুপ্তচরবৃত্তি, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
চীন নাকি ওয়াগনার গ্রুপের সাবেক যোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা থেকেও উপকৃত হতে চায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হতে পারে বলেও নথিতে ইঙ্গিত রয়েছে।
মস্কোর ভিতরে বেইজিংয়ের পদচারণা
রাশিয়ায় চীনের এই ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে এফএসবি উদ্বিগ্ন। সংস্থাটি দাবি করেছে, বেইজিং রুশ সেনা অভিযান, গবেষণা ও উন্নয়নের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে। এমনকি চীনা শিক্ষাবিদদের কার্যকলাপ ঘিরে রাশিয়ায় একটি আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তারা নাকি রুশ ভূখণ্ডের ওপর আঞ্চলিক দাবি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি তৈরি করছে।
চীনের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে রাশিয়ার খনি সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও। এফএসবির ভাষ্যমতে, তারা আর্কটিক অঞ্চলে নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের আড়ালে।
নথিতে বলা হয়েছে, চীনা বার্তা অ্যাপ উইচ্যাট ব্যবহারকারীদের নিয়েও নজরদারি চলছে। এমনকি কিছু রুশ নাগরিককে চীনের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে।
দৃশ্যমান বন্ধুত্বের আড়ালে রুশ শঙ্কা
এফএসবির আট পৃষ্ঠার ওই গোপন নথি অনুযায়ী, চীন এখন রাশিয়ার জন্য এক ‘গুরুতর হুমকি’। তবে চীন-রাশিয়ার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেই সতর্ক করেছে রুশ গোয়েন্দা সংস্থাটি। তাই ‘শত্রু’ বলেও সরাসরি তা প্রকাশ্যে বলার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে গোয়েন্দাদের ওপর।
২০২২ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসনের তিন দিন আগেই, ‘এন্টেন্টে-৪’ নামের একটি গোয়েন্দা কর্মসূচির অনুমোদন দেয় এফএসবি। উদ্দেশ্য, চীনা গোয়েন্দা তৎপরতা মোকাবিলা।
নথিতে দাবি করা হয়েছে, মস্কোয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, সাংবাদিক, গবেষক এবং ব্যবসায়ীদের নিজেদের পক্ষে টানতে চীন গোপনে তৎপর। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, এই ধরনের তৎপরতা ঠেকাতে হলে রাশিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হবে।
ভূরাজনীতির কৌশলে চীনের আগ্রাসী অবস্থান
উত্তর মেরুতে রাশিয়ার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চীন নাকি উচ্চশিক্ষা ও খনি খাত ব্যবহার করছে। বরফগলা এই অঞ্চলের ‘নর্থ সি রুট’ দিয়ে জাহাজ চলাচল সহজ হলে ইউরোপ-এশিয়া পণ্যবাহী নৌ চলাচলের সময় অনেকটাই কমে যাবে। সেই পথ দখলেই চীনের আগ্রহ।
এদিকে মধ্য এশিয়ায়, বিশেষ করে উজবেকিস্তানে চীন তার কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেছে বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে। এই অঞ্চলগুলো রাশিয়ার ঐতিহাসিক প্রভাব বলয়ে পড়ায়, বিষয়টি পুতিন প্রশাসনের জন্য স্পর্শকাতর।
পুতিন কি জানেন সব?
পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, পুতিন চীনের অ্যাক্টিভিটিস সম্পর্কে অবহিত, কিন্তু তারপরও তিনি সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিতে চান। তিনি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অন্তত ৪০টি বৈঠক করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পর এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। চীন রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা, আর রাশিয়া চীনকে চিপস, সফটওয়্যার, সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে।
তবে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, রাশিয়া-চীনের এই সম্পর্ক ‘উচ্চাভিলাষী কিন্তু সন্দেহপ্রবণ’। এফএসবির নথিটি একে ‘উত্তেজনাপূর্ণ ও গতিশীলভাবে বিকশিত হতে থাকা গোয়েন্দা যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল: রাশিয়াকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করা
বিশ্বব্যাপী দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ের জন্ম দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগেও বলেছেন, রাশিয়া-চীন জোট ভাঙতে হবে। কারণ, এই জোট গড়ে উঠলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে।
রাশিয়া-চীনের সম্পর্কের বাইরে যে বন্ধুত্ব, ভেতরে তা নয়, এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে এফএসবির নথি। বন্ধুত্বের ছায়াতলে বিরাজ করছে অবিশ্বাস ও গুপ্তচর আতঙ্ক। আর তাতে স্পষ্ট, নতুন বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য আরও অনিশ্চিত।
এমএইচডি/এমজে