৩২ বছর আগে ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতান্ত্রিক বিশাল বিক্ষোভ হয়েছিল, যা কঠোরভাবে দমন করে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি। শান্তিপূর্ণ সেই বিক্ষোভ কেবল বেইজিংয়েই অনুষ্ঠিত হয়নি, তিয়ানআনমেন স্কয়ারে গণহত্যার আগ পর্যন্ত তা পূর্ব তুর্কিস্তান এবং পুরো চীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চীনের তিয়েনআনমেন চত্বরে গণতান্ত্রিক সেই আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞ চালানোর দিনটিকে নানা আয়োজন স্মরণ করা হয়েছে বাংলাদেশে।
সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, পথনাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মোমবাতি প্রজ্জ্বালন, ফেসবুকে লাইভ অনুষ্ঠান এবং সেমিনার করে নিহতদের স্মরণ করা হয়।
এসব কর্মসূচি থেকে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ১৯৮৯ সালে চীনের সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ড এবং বর্তমানে উইঘুর মুসলিমদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয়।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশাদার নাটকের একটি দল তরুণ শিল্পীদের নিয়ে এ ব্যাপারে একটি নাটক পরিবেশন করে। এ সময় তারা বয়কট উইন্টার অলিম্পিক শিরোনামে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মোমবাতি প্রজ্জ্বালন কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
‘বয়কট উইন্টার অলিম্পিক ২০২২’ লেখা মাস্ক পরে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন করে নাগরিক স্বাধীনতা মঞ্চ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘ওপেন ডায়ালগ বাংলাদেশ' নামের একটি সংগঠন তিয়েনআনমেন হত্যাকাণ্ড ও উইঘুর মুসিলমদের নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে পথনাটক পরিবেশন করে।
দিনটি স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তিয়েনআনমেন চত্বরে গণতন্ত্রকামী মানুষের উপর চীনা সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ছবি দিয়ে দিনব্যাপী ' আলোকচিত্র প্রদর্শণীর' আয়োজন করে ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ।
এছাড়া শাহবাগ, জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিয়ানানমেন স্কয়ার হত্যাকাণ্ডের চিত্র তুলে ধরে প্রায় শতাধিক পোস্টার সাঁটানো হয়। তিয়ানআনমেন স্কয়ারে নিহতদের স্মরণে শাহবাগে মোমবাতি প্রজ্জ্বালন করে দুই শতাধিক তরুণ।
চীনে ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি উল্লেখ করে ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোট মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মিছিল করেছে। মিছিলটি সেখান থেকে বিজয়নগর মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট খায়রুল আহসান তিয়েনআনমেন চত্বরে চীনা সামরিক বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ড ও উইঘর মুসলমানদের উপর নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে ২০২২ সালে চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিতব্য 'শীতকালীন অলিম্পিক' বয়কটের আহ্বান জানান।
তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণহত্যা স্মরণে সিলেটে মানববন্ধন করেছে মানবাধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। ওই সময় গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের ওপর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং চলমান বর্বরতার নিন্দা জানান তারা। এক হাজারের বেশি মানুষ সেখানে জমায়েত হয়ে চীন সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় একই ইস্যুতে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, ৩২ বছর আগে, ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে বিশাল এক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, যা দমন করে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি।
ওই বিক্ষোভের সময়কার একটি ছবি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রতীকী ছবিগুলোর একটি হয়ে উঠেছিল - যাতে দেখা যাচ্ছিল, সেনা ট্যাংকের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছেন একজন আন্দোলনকারী।
১৯৮০'র দশকে চীন অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। বেসরকারি কম্পানি এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অনুমোদন দিতে শুরু করেছিল ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি।
নেতা ডেং শিয়াওপিং আশা করছিলেন, এর ফলে দেশের অর্থনীতি আরো বাড়বে এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হবে। তবে এই পদক্ষেপের ফলে দুর্নীতিও বাড়ছিল, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক উদারতার আশাও তৈরি হয়েছিল।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়েছিল। একটি পক্ষ চাইছিল দ্রুত পরিবর্তন, আরেকটি পক্ষ চাইছিল যেন বরাবরের মতোই রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
আশির দশকের মাঝামাঝিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা একটা সময় বিদেশে কাটিয়েছেন এবং নতুন চিন্তাভাবনা ও উন্নত জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।
আরো বেশি রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৮৯ সালের বসন্তে বিক্ষোভ আরো জোরালো হয়ে উঠছিল। সেটি আরো জোরালো হয় হু ইয়াওবাং নামের একজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে, যিনি কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয় দেখভাল করতেন।
রাজনৈতিক বিরোধীদের কারণে দুই বছর আগে দলের শীর্ষ পর্যায়ের পদ থেকে তাকে নীচে নামিয়ে দেয়া হয়। হু'র শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। এপ্রিল মাসের ওই অনুষ্ঠানে তারা জড়ো হয়ে বাকস্বাধীনতা এবং কম সেন্সরশিপের দাবি জানাতে থাকেন।
এর পরের কয়েক সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা তিয়েনআনমেন স্কয়ারে জড়ো হতে শুরু করে। সেই সংখ্যা একপর্যায়ে ১০ লাখে পৌঁছেছিল বলে ধারণা করা হয়। ওই স্কয়ারটি হচ্ছে বেইজিংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা।
এটি মাও সেতুং-এর সমাধিস্থলের কাছাকাছি, যিনি আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা। সেই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সভাস্থল গ্রেট হল অব দি পিপলেরও কাছাকাছি।
প্রথমদিকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। কিভাবে এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা ছিল দলের নেতাদের মধ্যে। অনেকে কিছুটা ছাড় দেয়ার পক্ষে ছিলেন, আবার অনেকে ছিলেন কঠোর পন্থা বেছে নেয়ার পক্ষে।
এই বিতর্কে শেষপর্যন্ত কট্টরপন্থীদের জয় হয়। মে মাসের শেষ দুই সপ্তাহে বেইজিংয়ে মার্শাল ল' জারি করা হয়। ৩ ও ৪ জুনে তিয়েনআনমেন স্কয়ারের দিকে এগোতে শুরু করে সৈনিকরা। ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য তারা গুলি করে, বাধা ভেঙেচুরে এবং বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে।
কারো জানা নেই, সেই বিক্ষোভে আসলে কতজন মারা গেছে। ১৯৮৯ সালে জুনের শেষ নাগাদ, চীনের সরকার জানিয়েছিল যে, বেসামরিক ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা কর্মী মিলিয়ে বিক্ষোভে দুইশোজন নিহত হয়েছে।
অনেকে ধারণা করেন, সেখানে কয়েকশত থেকে শুরু করে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করা হলে জানা যায়, সে সময় চীনে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার অ্যালান ডোনাল্ড বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, সেখানে ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৭ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০২১
এএটি