ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

লাইনে দাঁড় করিয়ে জাকাতের বিধান নেই

মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫২ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৫
লাইনে দাঁড় করিয়ে জাকাতের বিধান নেই

ইসলামি বিধানে, খাওয়া-পরার খরচ বাদ দিয়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্যমানের সম্পদ থাকলে জাকাত দিতে হবে। সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে।

জাকাতের সবচেয়ে বড় হকদার গরিব আত্মীয় ও প্রতিবেশী। পবিত্র কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘ধন-সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়। ’ -সূরা হাশর: ৭

আল্লাহতায়ালা আরও ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তাদের ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। ’ -সূরা জারিয়াত: ১৯

জাকাত নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেমন ইসলামে সুস্পষ্ট বিধি বিধান আছে, তেমনি জাকাত বণ্টনের ক্ষেত্রেও ইসলামে নিয়ম-পদ্ধতি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তির খেয়াল-খুশি কিংবা মর্জি চলতে পারে না। বর্তমানে অনেক জায়গায় যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেকে জাহির করার জন্য লোক দেখানো পদ্ধতিতে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি ও অর্থ দেয়া হচ্ছে তা মোটেও ইসলামসম্মত নয়। জাকাত হলো ধনীর অর্থে গরিব মানুষের হক বা অধিকার। জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা অবজ্ঞার ভাব প্রদর্শন করা যায় না।

জাকাত দেয়ার পদ্ধতি হলো জাকাতের হিসাব সম্পন্ন করে, দরিদ্র মানুষের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের কাছে জাকাত দাতা নিজে বা নিজের লোকদের মাধ্যমে প্রাপ্য অর্থ পৌঁছে দেয়া। নিজের বাড়ির সামনে অপমানজনকভাবে কাঙ্গালের মতো লাইনে দাঁড় করিয়ে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গির মাধ্যমে জাকাত প্রদানের বিধান ইসলামে নেই।

জাকাত প্রদাতা তো জাকাতের অর্থের মালিক নন। তাহলে তিনি কী করে জাকাতের অর্থ দিয়ে নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি কেনার সিদ্ধান্ত নেন? যারা জাকাতের অর্থের মালিক তারাই নির্ধারণ করবেন জাকাতের অর্থ দিয়ে তারা কি কিনবেন?

এমতাবস্থায় পবিত্র কোরআনে বর্ণিত পন্থায় জাকাত আদায় করতে বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাকাত বোর্ড ও দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। জাকাত বোর্ডের বিবৃতি ও আলেমদের অভিমতে বলা হয়েছে, লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে গরিবদের দাঁড় করিয়ে শাড়ি-কাপড় বিতরণ করে জাকাত আদায় হবে না।

তাদের অভিমত, ইসলামের বিধান হলো, ডান হাত দান করলে বাম হাতে যেন জানতে না পারে। সেখানে জাকাতের মতো ফরজ ইবাদত এভাবে লোক দেখিয়ে মাইকিং করে দিলে তা আদায় হবে না।

গরিব মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে জাকাতের নামে শাড়ি-কাপড় বিতরণকে অসুস্থ মানসিকতা বলে মন্তব্য করেছেন শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ। তিনি বলেন, এভাবে জাকাত আদায় হবে না। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বা লোকে মস্ত বড় দাতা বলে প্রশংসা করুক বা পার্থিব কোনো প্রয়োজনে দান করলে আল্লাহ তা কবুল করেন না।

শোলাকিয়ার ঈমাম আরও বলেন, জাকাতের নামে ৫০ হাজার টাকায় ১০০ শাড়ি না কিনে পুরো টাকাটাই একজন দরিদ্রকে দেওয়া উচিত। যাতে সে এই টাকা বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হতে পারে। পরের বছর যেন নিজেই জাকাত দিতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফাসসিরে কোরআন মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়্যুবী বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে প্রাণহানির মতো ঘটনার জন্য কতিপয় ধনাঢ্য ব্যক্তি, সমাজ ব্যবস্থা ও সরকার সমানভাবে দায়ী। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে জাকাত আদায় করা হয় তা শরিয়তসম্মত কোনো পন্থা নয়; বরং এটা লোক দেখানো এবং নিজেকে প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু নয়। জাকাত দেয়ার পদ্ধতি হচ্ছে জাকাত নির্দিষ্ট করে তা তার প্রাপকদের কাছে নিজে সরাসরি অথবা নিজের লোক দিয়ে পৌঁছে দিতে হবে। আর শাড়ি লুঙ্গি জাকাত দেয়ার কোনো বিধান ইসলামে নেই। জাকাত দেয়ার নিয়ম হলো এমনভাবে জাকাত দিতে হবে যে, সারা বছরে বছরের জন্য তার যেন দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়। জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে পাতলা শাড়ি, ফিনফিনে লুঙ্গি এসব কে আবিষ্কার করেছে? অথচ এখনো এগুলো দেয়া হচ্ছে।

জাকাত দেয়ার বর্তমান প্রবণতা বন্ধ করে একটি স্বাধীন জাকাত বোর্ড গঠন করে তার মাধ্যমে জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থা করে দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন মাওলানা আইয়্যুবী।

বনানী কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব মুফতি মাসুম আহমদ বলেন, জাকাত প্রদানের বর্তমান পদ্ধতি সরাসরি অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড। জাকাত এভাবে দেয়ার বিধান ইসলামি শরিয়তে কখনো ছিল না। কিছু স্বার্থান্বেষী বাহাদুরি প্রকাশ করার জন্য এমন ব্যবস্থা করে। বলতে পারেন এটা এক ধরনের ভণ্ডামি।

তিনি বলেন, জাকাত দিতে হবে বলা হয়েছে। যেকোনো দান দিতে হবে ডান হাত দেবে বাম হাত জানবে না। আর জাকাত হলো এটা এখরাজুল মাল। জাকাততো আপনাকে বের করে দিয়ে আসতে হবে। নেয়ার জন্যতো লাইন ধরানোর দরকার নেই। প্রত্যেকে যার যার জাকাত নিজস্ব চিন্তা অনুযায়ী বিভিন্ন হকদারের কাছে পৌঁছে দেবে।

মুফতি মাসুম আরও বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনের একটা মাধ্যম হলো জাকাত। নিম্নমানের একটা শাড়ি একটা লুঙ্গি এগুলো দিয়েতো দারিদ্র্য বিমোচন হলো না। বরং নির্ধারিত পন্থায় নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আয়বর্ধক কাজে তাদের জাকাত দেয়া যেতে পারে। বর্তমান জাকাত প্রদানের পদ্ধতি সরাসরি কোরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামি শরিয়তের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।

মাদ্রাসা ইমাম বোখারির প্রিন্সিপাল ও মসজিদ আল মাগফিরাহ উত্তরার খতিব মুফতি অহিদুল আলম বলেন, জাকাত বর্তমানে যেভাবে আদায় হচ্ছে এ আদায় সুষ্ঠুভাবে আদায় এবং সুষম বণ্টন হচ্ছে না। কিছু লোক জাকাত দেয় জাকাতের মাধ্যমে জনগণ থেকে প্রচার নিতে চায়। শরিয়তে এভাবে জাকাত দেয়ার কোনো পদ্ধতি নেই। শরিয়তে জাকাত দেয়ার পদ্ধতিটা হলো জাকাত যিনি পাবেন তার কাছে এটা পৌঁছে দেয়া। কিন্তু এভাবে যে মাইকিং করে লাইন ধরে জাকাত নেয়ার জন্য গিয়ে লোক মারা যায় তার জন্য সরকার অনেকটা দায়ী। যে সরকার নামাজকে বাধ্যতামূলক করবে সেই সরকারই জাকাত আদায় করতে পারবে। নতুবা ধনবান ব্যক্তিদের নিজেদের ব্যবস্থাপনায় জাকাত পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে যে সিস্টেমের কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে এর জন্য এটা বিচারের আওতায় আনা উচিত।

প্রসঙ্গত, গতকাল শুক্রবার ময়মনসিংহ শহরের মো. শামীম তালুকদারের নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে ভোর ৫টায় প্রচণ্ড হুড়াহুড়ি ও ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে ২৭ জন নিহত এবং অর্ধশত নারী-পুরুষ আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ধরনের ঘটনা প্রায় বছরই ঘটে থাকে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও অতীতে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘন্টা, জুলাই ১৬, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।