রায়ে খুশি তার মা সাফিয়া বেগম, খালা শাহিনুর বেগম মামা মামলার বাদী নজরুল চৌধুরীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও। সন্তুষ্ট আদুরীর পক্ষে মামলাটি পরিচালনাকারী করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি।
চার বছর আগের ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতন করে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার ওই আলোচিত মামলার রায় মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দেন ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার।
গৃহকর্ত্রী নদীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। এ টাকা নির্যাতিত আদুরীকে দিতে হবে। অপর আসামি নদীর মা ইসরাত জাহান খালাস পেয়েছেন।
মামলার রায় শুনতে পরিবারের অন্যদের নিয়ে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে এসেছিল বর্তমানে ১৪ বছরের কিশোরী আদুরী। পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামের বাড়ি থেকে লঞ্চযোগে সোমবার (১৭ জুলাই) সকালে ঢাকায় আসেন তারা। রাতে উত্তর বাড্ডায় আদুরীর দুলাভাইয়ের বাসায় অবস্থান করে মঙ্গলবার সকালে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসেন।
মামলার দুই আসামির মধ্যে গ্রেফতারকৃত আদুরীর গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। রায়ের পর তাকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে ফের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জামিনে থাকা অপর আসামি নদীর মা ইশরাত জাহানও আদালতে ছিলেন।
নির্যাতনের সময় গৃহকর্ত্রী নদী আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়ায় জিহবা ক্ষতিগ্রস্ত, তাই স্বাভাবিক মানুষের মতো কথাও বলতে পারে না আদুরী। রায়ের পর অস্পষ্ট ভাষায় বাংলানিউজকে সে বলেছে, ‘নির্যাতনের বিচার পেয়েছি, আমি খুশি’।
সন্তোষ জানিয়ে বড় ভাই সোহেল মৃধা বলেন, ‘আমার বোনরে যে নিয়া এই দোজগের আগুনে ফালাইছছেন, সেই চুন্নু মিয়া আগে থাইকা ছাড়া পাইয়া যাওয়ায় কষ্ট হইছিল। তয় মূল অপরাধীর সাজায় খুশি’।
মা সাফিয়া বেগম বলেন, ‘যতোই অভাব-অনটন থাউক, আইজ মাইয়াডার দশা এইরহম অইবে হ্যা বোঝলে কামে দেতাম না। তারে যে এই দশা করছে, তার শাস্তি পাইছি, ভালো লাগতাছে’।
নদীর উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে বলে মনে করেন বাদী আদুরীর মামা নজরুলও।
আদুরীর পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অ্যাডভোকেট সালমা ও অ্যাডভোকেট রিংকি বলেন, ‘আমরা সঠিক রায় পেয়েছি’।
২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় গৃহকর্মী আদুরীকে। উদ্ধারের সময় তার শরীরে ছিলো অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন।
পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ২৯/১, সুলতানা প্যালেসের দ্বিতীয় তলায় সাইফুল ইসলাম মাসুদের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতো শিশু আদুরী।
দীর্ঘদিন মারধর, গরম খুন্তি ও ইস্ত্রির ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীর পোঁচানো, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াসহ নানা নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে মৃত ভেবে ওই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন মাসুদের স্ত্রী গৃহকর্ত্রী নদী ও তার পরিবারের লোকজন।
প্রায় দেড় মাস আদুরীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যখন তাকে রিলিজ দেওয়া হয়, তখনও সে ভালোভাবে কথা বলতে পারতো না। শরীর ছিলো প্রচণ্ড দুর্বল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই বছরের ০৭ নভেম্বর আদুরী চলে যায় পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে।
নির্যাতনের ঘটনায় তিনদিন পর ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে মামলা করেন আদুরীর মামা নজরুল চৌধুরী।
তবে পুলিশি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে মাসুদ, চুন্নু মীর ও রনিকে বাদ দেওয়া হয়। তদন্তে নদীর মা ইসরাত জাহানের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় নতুন করে তাকে আসামি করা হয়।
অভাব আর ধার-দেনা জর্জরিত বড় ভাই মো. সোহেল মৃধার সংসারে বাবাহীন আদুরী স্থানীয় পূর্ব জৈনকাঠি সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
এমআই/এএসআর