ঢাকা: আজ (বুধবার) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক বেদনাঘন, মর্মন্তুদ, দুঃসহ স্মৃতির একটি দিন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের এই দিনে (১৪ ডিসেম্বর) বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে মেধা শূন্য করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে হানাদাররা।
যুদ্ধে জয়ী হলেও বাঙালি যেন আর কোনোদিন বিশ্বসভায় শিক্ষা, মননে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, এগিয়ে যেতে না পারে- এই ছিল পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয়।
এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের নীল নকশাটি বাস্তবায়নের জন্য হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের আগমুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বরকে বেছে নেয়।
অনিবার্য পরাজয় উপলব্ধির পর তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মেধাবী মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানিরা।
বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য আলোকিত মানুষদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৪ ডিসেম্বর।
বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রায়ের বাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলা, মিরপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে একে একে হাত-পা-চোখ বেঁধে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালায় হানাদাররা।
বর্বরোচিত সেই হত্যাকাণ্ড হিটলারের খুনে বাহিনী গেস্টাপোর বর্বরতাকেও হার মানায়।
পরে এসব জায়গায় পড়ে থাকা আলোকিত ও দেশ বরেণ্য মানুষগুলোর মৃতদেহ পাওয়ার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয় পাকিস্তানি ঘাতকদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয় বিশ্ববিবেক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৪ ডিসেম্বরকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ঘাতকদের হাতে সেদিন দেশের যেসব সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তাদের মধ্যে শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী, ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আবুল খায়ের, ড. আনোয়ার পাশা, আলতাফ মাহমুদ, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন অন্যতম।
বাঙালির দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসে বরেণ্য এই বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবদান রয়েছে।
জাতিকে তারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীন দেশে একটি উন্নত জাতি গঠনে তেমনি থাকত তাদের মূল্যবান অবদান।
দেরিতে হলেও নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রথম সারির ও নেতৃস্থানীয় রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ও ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মো. কামারুজ্জামান, রাজাকার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে৷
ফাঁসি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশার বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেমের।
তবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত চৌধুরী মইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান বিদেশে পলাতক থাকায় বিচারের রায় কার্যকর করা এখনো সম্ভব হয়নি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, ছাত্র, যুব, নারী সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা ইত্যাদি।
দিবটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০২২
এসকে/এসএএইচ/এমজে