ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

গুড় তৈরিতে কাটছে ব্যস্ত দিন

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০২৩
গুড় তৈরিতে কাটছে ব্যস্ত দিন চলছে গুড়-পাটালি তৈরির কাজ

বগুড়া: প্রকৃতিতে ঢেউ খেলছে পৌষ। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় মোড়ানো থাকছে উত্তরাঞ্চল।

এরমধ্যেই বগুড়ায় খেজুর রসে গুড়-পাটালি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা।

শীতের আগমনে আগে থেকেই শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। এখনও চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতে মাটির হাঁড়িতে রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়। সূর্য ওঠার আগে গাছিরা রসভর্তি মাটির হাঁড়ি গাছ থেকে নামিয়ে আনেন।

পরে মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দিয়ে তরল গুড় ও পাটালি তৈরি করেন। নতুন খেজুর রসের পাটালি তৈরির পর তা চলে যায় বাজারে। রস সংগ্রহ, গুড়-পাটালি তৈরি এবং বাজারে বিক্রি নিয়ে এখন চলছে গাছিদের ব্যস্ত সময়।

গ্রামের ঘরে ঘরে এখন খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়-পাটালির মুড়ি-মুড়কি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়েছে। বাজারে চিনির দাম তুলনামূলক কম হলেও গুড়-পাটালির চাহিদা কমেনি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় গাছিরা।

মঙ্গলবার (৩ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বগুড়ার কাহালু উপজেলায় দুর্গাপুর ইউনিয়নের বান্দাগারা গ্রামে গুড়-পাটালি তৈরিতে গাছিদের ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা যায়।

বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে কাহালু, শেরপুর, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, আদমদীঘি বরেন্দ্রখ্যাত উপজেলা হিসেবে পরিচিত। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এখন বগুড়ায় ৪৪ হাজার ৩০০টির মতো খেজুর গাছ রয়েছে। তবে খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে।  

রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আরপাড়া গ্রামের মহররম আলীর ছেলে গাছি মো. মিন্টু আলী প্রতি বছরের মতো পাটালি তৈরির কাজে চলে এসেছেন বগুড়ায়। সঙ্গে একই গ্রামের ফজলু মিয়াও এসেছেন। আগে তাদের চার-পাঁচ জনের একটি দল ছিল। গেল বছর তিনজন না আসায় মিন্টু ও ফজলু দুজনের দল বেঁধেছেন।

গাছি ও স্থানীয়রা জানান, মোট ১৪৫টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে করা হয়। এরপর তরল গুড় ও পাটালি তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি হয়। রসের জন্য গাছের পরিচর্যায় দীর্ঘ সময় লাগে। সব মিলিয়ে চার মাস ফজলুদের বগুড়ায় থাকতে হয়।

গাছি মিন্টু আলী ও ফজলু বাংলানিউজকে জানান, বিগত আট বছর ধরে তারা বগুড়া কাহালু উপজেলায় নিয়মিত আসেন খেজুর রস থেকে গুড় তৈরির কাজে। এটিই তাদের ব্যবসা। আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে গাছের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করা হলেও এ বছর শুরু করেছেন শেষের দিকে।  

এ বছর মোট ১৪৫টি গাছ রস পাওয়ার উপযোগী করেছেন তারা। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে দুই-তিনদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছ থেকে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হয়। ধীরে ধীরে তা বাড়ে। ধাপে ধাপে সব গাছের রস সংগ্রহ করেন তারা।

তারা বলেন, গাছ পরিচর্যা ও কাটার পর প্রথমদিকে প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ কেজি করে পাটালি তৈরি হয়। তারপর মাঝামাঝি থেকে পুরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫০ কেজি থেকে ১২০ কেজি পাটালি ও তরল গুড় তৈরি করা হয়। এ বছর প্রতি কেজি পাটালি ও তরল গুড় বাজারে পাইকারদের কাছে ১৩০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

ফজলু ও মিন্টু জানান, এ বছর মোট ১৪৫টি গাছের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা আছে। এর মধ্যে কারো একটি, দুটি, পাঁচটি বা ১৫-২০টি আবার কারো ২০-৩০টি করে গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছের জন্য ২০০-২৫০ টাকা বা দেড় থেকে দুই কেজি গুড় দিতে হয়। গেল বছরের মতো এই বছর গুড় তৈরির স্থানের ভাড়া দিতে হচ্ছে না তাদের। যদি স্থানের ভাড়া দিতে হতো, তাহলে অতিরিক্ত চার থেকে ছয় হাজার টাকা গুনতে হতো।

প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে তারা দুজন নির্দিষ্ট গাছগুলোতে উঠে তাতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে আসেন। এরপর রাত ৩টার দিকে ঘুম ভাঙলে গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নেন। ভোর হতেই সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা টিনের বড় তাওয়ায় ঢেলে আগুন জ্বেলে গুড়-পাটালি তৈরির কাজে নেমে পড়েন। রস থেকে গুড় তৈরির কার্যক্রম চলে দুপুর পর্যন্ত।

রসে জ্বাল দিতে দিতে তা ঘন হয়। এরপর তা নামিয়ে একটি গোলাকার হাড়িতে ঢেলে বাঁশের একটি সরু লাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে সেগুলোর ঘনত্ব আরও বাড়ে। পরে তা কাঠের তৈরি চার কোণা খোপের মধ্যে ঢেলে পাটালি আকার দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়।  

গাছিরা বলেন, ব্যবসা আগের মতো নেই। অন্যদিকে রাত-দিন এক করে এ কাজ করে যেতে হয়। প্রতি বছরই কাজ শুরুর আগেই পাইকারদের থেকে টাকা ধার নিয়ে চলতে হয় তাদের। তাই গুড়-পাটালি পাইকারদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। ফলে তেমন লাভ হয় না।  

বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু করে মোটামুটি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর রস সংগ্রহ করা যায়। এখন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছিরা এই রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করছেন। বাণিজ্যিকভাবে কেউ খেজুর গাছ লাগায় না। প্রাকৃতিকভাবেই এসব খেজুরগাছ জন্ম নিয়েছে। পতিত জমি, ভিটা, জমির আইলসহ বিভিন্ন স্থানে এসব খেজুর গাছের দেখা মেলে।

বগুড়া জেলায় একটা সময় বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ ছিল। পর্যায়ক্রমে মানুষ সিংহভাগ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছে। এছাড়াও খেজুর গাছের বয়স বাড়ার কারণে সব গাছ থেকে রস উৎপাদনও হয় না বলেও জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০২৩
আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।