জামালপুর থেকে: ছবিতে অসহায় এই মুখগুলো একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডে বিস্মিত, মর্মাহত পরিবারের। মাথার ওপর একমাত্র বটবৃক্ষের ছায়া বাবাকে হারিয়ে আজ এতিম তিন সন্তান।
জীবনের এমন করুণ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কেবলই তারা চাইছেন হত্যার বিচার। পরিবারের কাছে স্বাধীনচেতা মানুষটি যে আজ কেবলই অতীত।
দু-দিন আগেও মানুষটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখেছেন সদর্পে। প্রতিবাদ করেছেন অন্যায় আর নৃশংসতার বিরুদ্ধে। সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার কারণেই কি না আজ প্রাণ দিতে হলো তাকে। জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে আজ প্রাণ দিতে হলো কেবলই সংবাদ প্রকাশের জেরে।
গত ১৪ জুন রাতে জামালপুরের বকশিগঞ্জে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে রাতের আধারে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে নির্মমভাবে মারধর করে সন্ত্রাসীরা। পরদিন বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) দুপুরে ময়মনসিংহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার মৃত্যু হয়।
ঘটনাস্থলে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম সড়ক দিয়ে আসার সময় হঠাৎ তাকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি। পরে আরও কয়েকজন এসে আহত নাদিমকে মারতে মারতে অন্ধকার গলিতে নিয়ে যায়। পাঁচ থেকে ছয়জন মারধরে অংশ নিলেও এসময় চারপাশে আরও ৫-৬ জন হামলাকারীকে দেখা গেছে ফুটেজে।
বকশীগঞ্জ উপজেলা শহরের গরুহাটি কাচারিপাড়া গ্রামে সাংবাদিক নাদিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, শোকার্ত পরিবারটির কান্না যেন থামছেই না। হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে নিজ বাড়ি ফেরা পর্যন্ত একইভাবে কান্নার আওয়াজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নাদিমকে দাফনের দ্বিতীয় দিনেও কাঁদছেন তারা। ব্যবহৃত আইডি কার্ডগুলো দেয়ালে ঝুলছে, কিন্তু সাংবাদিক নাদিম আর দুনিয়াতে নেই।
নিহত সাংবাদিক নাদিম রেখে গেছেন একটি মেয়ে ও দুটি ছেলে। মেয়ে রাব্বিরাতুল জান্নাত অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। আর দুই ছেলের মধ্যে ডিগ্রিতে পড়ছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত এবং ছোট ছেলে রিশাদ আব্দুল্লাহ পড়ে প্রথম শ্রেণিতে।
বাবার মৃত্যুর বিষয়টি মেনেই নিতে পারছেন না মেয়ে অনার্স পড়ুয়া মেয়ে জান্নাত। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১৪ জুন বাবাকে যেদিন মারা হয়, সেদিন ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে এসেছি। ১৫ জুন বাবা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন আমাকে নিয়ে সাত কলেজের তিতুমীরে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাবা আমাকে আর ঢাকায় নিয়ে যেতে পারলেন না। আমাকে ছাড়াই চলে গেলেন পরপারে। তাকে হত্যা করা হলো। আমি এর বিচার চাই। শুধু আমাকেই না, আমার দুই ভাইকেও এতিম করেছে তারা। আমরা এখন কীভাবে চলবো, আমাদের পড়াশোনার খরচ কে চালাবে? বাবা আজ আমাদের মধ্যে নেই, এটা ভাবতেই পারছি না!
রাব্বিরাতুল জান্নাত অভিযোগ করে বলেন, বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর শাস্তি চাই। তিনি ও তার ছেলে ফয়সাল মিলে আমার বাবাকে ইট দিয়ে আঘাত করে মেরেছে, তাদের বিচার চাই।
এতিম তিন সন্তানের জননী মনিরা বেগম বলেন, আমার স্বামী ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গত বছর। সেই কিস্তি এখনো চলছে। আমি একটা ছোটো চাকরি করি। সেখানে বেতন পাই ১৭ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা কিস্তিতেই দিতে হয়। তাহলে থাকে আর মাত্র ৬ হাজার টাকা। এই ৬ হাজার টাকা দিয়ে এখন সংসার কীভাবে চালাবো। ছেলে মেয়ে দুইজনেই পড়ালেখা করে। তাদের খরচ কীভাবে চালাবো। আমি আজ নিঃস্ব হয়ে গেছি। যারা আমাকে বিধবা ও আমার সন্তানদের এতিম করেছে, তাদের আমি ফাঁসি চাই।
নিহত সাংবাদিক নাদিমের বড় ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত বলেন, আমার বাবা কলেজ মোড়ে একটি দোকান নিয়েছিলেন। সেই দোকানে আমি যেতাম। হয়তো বাবা আমার জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন, যেন পড়াশোনার পাশাপাশি আমি কিছু একটা করি। কারণ আমার কম্পিউটার টাইপিং স্কিল ভালো। সেই দোকানটি এখন আছে, কিন্তু আজ বাবা আর নেই! দোকান দিয়ে এখন কী করবো? বাবা আমাকে দিয়ে কী করাতে চেয়েছিলেন, সেটাও বাবার থেকে জানা হলো না! তার আগেই বাবাকে হত্যা করলো তারা।
পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত বাংলানিউজকে বলেন, মূলত কয়েক মাস আগে বকশিগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগের কমিটি প্রকাশ হয়। সেই কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুইজনের বাবা রাজাকার- এমন একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। যার দায় পড়ে আমার বাবার ওপর। আমার বাবা নাকি সেই সংবাদে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। পরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির কাছ থেকে হুমকি আসে। এর কয়েকদিন পর মধ্যবাজার এলাকায় বাবার ওপর একটি হামলা হয়। সেই হামলায় যুবলীগ নেতা শামীম খন্দকার ও ইসমাইল হোসেন নেতৃত্ব দেন। তার কয়েকদিন পর মাহমুদ আলম বাবু চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে বেশ কয়েকটি নিউজ করেন বাবা। এ ঘটনায় বাবাকে কয়েকবার হুমকি দেন বাবু চেয়ারম্যান ও তার ছেলে ফয়সাল।
আওয়ামী লীগের এক মিটিংয়ে বাবু চেয়ারম্যান সরাসরি সাংবাদিক নাদিমকে খুন করার হুমকি দেন উল্লেখ করে নিহতের ছেলে বলেন, পরে সেই নিউজগুলোর কারণে বাবু চেয়ারম্যান বাবার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দেন। বুধবার (১৪ জুন) দুপুরে সেই মামলা খারিজের খবর পাওয়ার পর আবারও বাবাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। চেয়ারম্যানের ছেলে ফয়সাল বাবাকে মেরে ফেলতে চায়। সেই হুমকিই বাস্তবায়ন করলো চেয়ারম্যান, তার ছেলে ও তাদের লোকজন।
বাবা হত্যার বিচার চেয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন রিফাত বলেন, আমার বাবা আজ দুনিয়াতে নেই। আমি এই হত্যার বিচার চাই। জড়িতদের ফাঁসি চাই।
গত বুধবার (১৪ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে বকশিগঞ্জ উপজেলার পাথাটিয়া এলাকার ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথের সামনে অতর্কিত আঘাত করে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হয়।
এরপর দেশীয় অস্ত্রধারী ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত তাকে সড়ক থেকে মারধর করতে করতে টেনেহিঁচড়ে অন্ধকার গলিতে নিয়ে যায় এবং তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। ওই সময় সহকর্মী মুজাহিদ তাদের আটকাতে গেলে তাকেও মারধর করে দুর্বৃত্তরা।
পরে মুমূর্ষু অবস্থায় সহকর্মী মুজাহিদ ও স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু আঘাত গুরুতর হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসক তাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।
পরে বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) বেলা পৌনে ৩টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২৩
এসএফ/এনএস