বরিশাল: প্লেন আকাশপথেই চলাচল করে, তবে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার নদী ও খালে প্রায়ই দুরন্ত গতিতে প্লেনের মতো একটি বাহন চলতে দেখে সবাই অবাক হচ্ছেন। তবে দূর থেকে এটিকে প্লেন মনে হলেও আসলে এটি প্লেনের আদলে তৈরি ছোট্ট নৌযান।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্লেনের মতো দেখতে নৌযানটি কয়েকমাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্থানীয় বিভিন্ন নদী আর খালে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুবর্ণা এক্সপ্রেস-২’।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বিশারকান্দি ইউনিয়নের চৌমুহনী বাজারের ওয়ার্কশপ মিস্ত্রী গোলাম মোস্তফা দুই বছরের বেশি সময় ব্যয় করে বিশেষ কায়দায় তৈরি করেছেন এ নৌযান। কাজের ফুসরতে গ্রামের কচিকাচাদের অনেককে নিয়ে প্রায়ই ভ্রমণে বের হন তিনি। আর তখনই আশপাশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখেন সেটি।
জানা গেছে, ইঞ্জিনের দক্ষ মেকানিক হওয়ায় গোলাম মোস্তফাকে তার নিজ এলাকায় মোস্তফা ফিটার বা ফাইন্ডার নামে সবাই চেনেন। আর গোলাম মোস্তফার লোহা-লক্করের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রায় ২৭ বছরের। প্রকৌশল শাস্ত্রে কোনো একাডেমিক শিক্ষা না থাকলেও ওয়ার্কশপে কাজ করার সুবাদে অভিজ্ঞতার ঝুলিটা বেশ বড়। তাই গতানুগতিক কাজ করতে করতে যখন হাপিয়ে ওঠেন, তখন নতুন কিছু তৈরি উদ্যোমী হন তিনি।
আর গোলাম মোস্তফার মতে তার ভিন্নধর্মী এ সৃষ্টিগুলো মানুষের উপকারে কোনো না কোনোভাবে আসছে।
তিনি বলেন, এক সময়ে আমি অন্যের ওয়ার্কশপে কাজ করতাম আর এখন চৌমুহনী বাজারে নিজের ওয়ার্কশপ আছে। কাজের চাপ না থাকলে স্টিল ও লোহা জাতীয় জিনিস দিয়ে নিজের মতো করে কিছু না কিছু তৈরি করার চেষ্টা করি সবসময়। যেমন এ অঞ্চলের কৃষকেরা ভালো ও মজবুত লাঙলের সংকটে থাকেন, আর কাঠের লাঙল তো বছরে বছরে পাল্টাতে হয়। তাই স্টিলের লাঙল বানিয়েছি, যা দীর্ঘস্থায়ী ধারালো হওয়ায় সহজেই গভীরভাবে জমি চাষ করা যায়। আবার আমাদের এ অঞ্চলে নদী ও খালই তো বেশি, তাই নৌকায় চলাচল সবার। আর কাঠের তৈরি অধিকাংশ নৌকা কয়েক বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। নৌকা যদি কাঠবডি না হয়ে লোহার বডি হয় তাহলে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। এ কথা চিন্তা করে আমি লোহার নৌকাও তৈরি করেছি।
গোলাম মোস্তফা বলেন, নদীবেষ্টিত এ অঞ্চলে বর্ষাকালে ধানের জমিতে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সাধারণ ট্রাক্টর চাষ দিতে পারে না। আর সঠিক সময়ে চাষ না দিলে ভালোমানের ফসলও সঠিক সময়ে পাবে না কৃষক। তাই নিম্নাঞ্চলের কথা চিন্তা করে আমি ভাসমান ট্রাক্টর বানিয়েছি।
তারই ধারাবাহিকতায় ‘প্লেন’ তৈরি করেছেন জানিয়ে গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, আমরা গ্রামের খেটে-খাওয়া মানুষ। খরচের দিক তাকালে চাইলেই তো আর প্লেনে উঠতে পারি না। তাই চিন্তা করলাম প্লেনে ওঠার সক্ষমতা না থাকলেও নিজে একটা প্লেন তৈরি করি। যেটি আমাদের চলাচলের অন্যতম পথ নদীতে চলবে। নিজেও চড়তে পারলাম আবার লোকজনকে চড়াতে পারবো। সেই সঙ্গে যারা দেখবে তারও বলবে প্লেন আসছে।
২০২২ সালে মাথায় প্লেন বানানোর চিন্তা আসে জানিয়ে মোস্তফা বলেন, আকাশে উড়তে পারবে এমন প্লেনতো আমার দ্বারা বানানো সম্ভব না। বিকল্প হিসেবে পানিতে চলতে পারে এমন প্লেন তৈরির পরিকল্পনা করি। একটু একটু করে প্রায় দুই বছর কাজ করে প্লেনের আদলে নৌযানটির কাজ শেষ করি। প্রথমে মানুষ অনেক প্রশ্ন করতো, কি বানাচ্ছি? পূর্ণাঙ্গ করার আগ পর্যন্তও মানুষ ধারণাই করতে পারেনি আসলে কী হচ্ছে।
প্লেনটি চলাচল উপযোগী করতে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সঠিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মানুষের উপকারে আসে এমন টেকসই উদ্ভাবন করা সম্ভব। আর আমি সেটা পারবো বলেও বিশ্বাস করি।
জানা গেছে, ১৮ জন যাত্রী নিয়ে ২৪ ঘণ্টাই নৌপথে চলাচলের সক্ষমতা রয়েছে গোলাম মোস্তফার প্লেনের। মোটর ইঞ্জিন চালিত এ বাহনটি এখন পর্যন্ত নিজেই পরিচালনা করছেন।
এ বিষয়ে বাইশারী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নান্না তালুকদার বলেন, মরিচবুনিয়ার বাসিন্দা মোস্তফার বানানো নদীর প্লেনটি এলাকায় খুবই জনপ্রিয়। অনেকেই প্লেনটি দেখতে আসে। চড়ে ঘুরে বেড়াতে আসে। মোস্তফা গ্রামের ছেলে হলেও তার মধ্যে উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা আছে। এর আগেও কয়েকটি উদ্ভাবন করেছিলেন যা মানুষের উপকারে আসছে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০২৪
এমএস/আরআইএস