ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আমরা দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে সংস্কার করবো: উপদেষ্টা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২৪
আমরা দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে সংস্কার করবো: উপদেষ্টা

ঢাকা: দুর্নীতি কমিয়ে উন্নয়নকে জনগণের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন, রেল ও বিদ্যুৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবীর খান।

শনিবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) ও চাইনিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের আয়োজনে ‘সংস্কার ও টেকসই উন্নয়নের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা জানান।

উপদেষ্টা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতেই এ সরকার কাজ করছে। বিশাল ঋণের বোঝা রেখে গেছে এ সরকারের ওপর। যা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা দুর্নীতির যে অবকাঠামো ছিল সেটা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলেছি। আমরা দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে সংস্কার করবো।

উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবীর খান বলেন, এ সরকারের সঙ্গে অন্য সরকারের পার্থক্য হলো- অন্য সরকারের নির্বাচন করতে হয়, টাকা লাগে, মাস্তানি করা লাগে। কিন্তু আমাদের সরকার ক্ষমতায় যায়নি; আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। ছাত্ররা আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে। সুতরাং কায়েমি শাসনে দায়বদ্ধ নই। আমরা দায়বদ্ধ হাজারো শহীদদের প্রতি। ত্রিশ হাজারের বেশি আহতদের প্রতি।

তিনি বলেন, সরকার আমানত। হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্পে, এটা ব্যক্তিগত টাকা না জনগণের টাকা। এটা মাথায় রাখা উচিত। এ সরকারের কাছে জন প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। সবাই ভাবেন আমাদের কাছে জাদুর কাঠি আছে। আসলে কিছু নেই আমাদের কাছে। ব্যাংকে টাকা নেই। রাজনীতিবিদরা উসখুস করছেন কবে ক্ষমতায় আসবেন। আমরাও চাই নিজেদের কাজে ফিরে যাই।

ফাওজুল কবীর খান আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ। আমরা এখানে একটা কাজ করেছি, দুর্নীতির কাঠামো ভেঙে দিয়েছি। বিইআরসির আগের কাজ ফিরিয়ে দিয়েছি। ঢাকা মেট্রোয় সাবেক সচিব হতে হবে বলে যে বিধান ছিল, সেটি বাদ দিয়েছি। যার অভিজ্ঞতা আছে তিনিই এখানে কাজ করতে পারবেন। আবার পাওয়ার গ্রিডে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এভাবে আমরা কাঠামোগত পরিবর্তন করতে শুরু করেছি।

কর্ণফুলী টানেলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, কোন প্রকল্প দরকার, কোনটা দরকার নেই সেটা জানতে আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি। বছরে বিশাল অংকের এলএনজি আমদানি করা হয়। দেশে গ্যাসের সন্ধান না পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে এটা বাড়তে থাকবে। ভোলায় ১০টা কূপ খননের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে গ্যাস পেলে এলএনজি আমদানি কমবে। আমরা উন্নয়নকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে কাজ করছি।

পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগে অনেক ব্যয় হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা আরও বলেন, প্রকল্পগুলোয় দেখা গেছে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। আগে ঠিকাদার ঠিক করে পরে টেন্ডার করা ছিল আগের নীতি। ই-টেন্ডার মানে স্বচ্ছতা হবে, কিন্তু তাতো হয়নি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আর না। রেলের প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে না, ব্যয়ও বাড়বে না। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণই আমাদের লক্ষ্য। আমরা দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে সংস্কার করবো। এসব কাজে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা চান তিনি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাদাত আলী বলেন, বিগত দিনে সকল প্রকল্প যে অপরিকল্পিত সেটা বলা যাবে না। তবে ভুল তো ছিলই। যেমন, যেখানে যেটার প্রয়োজন নেই সেখানে সেই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামীতে যে প্রকল্প নেওয়া হবে তা যেন বিগত দিনের মতো না হয়। জনগণকে আমরা প্রকল্প সম্পর্কে জানাবো। জনবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা আমরা করতে চাই। আগে যে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করা হয়েছে তার লাগাম টেনে ধরতে হবে। নতুন সরকারের সঙ্গে এ খাতকে এগিয়ে নিতে চাই।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার অনেক উন্নয়ন হয়েছে ঠিক কিন্তু সেটা কিসের বিনিময়ে হয়েছে সেটা দেখতে হবে। ওই সময় প্রকল্প নেওয়া, কেনাকাটা এমন কি কর্মকর্তাদের নিয়োগ বদলির ক্ষেত্রেও সরকারের ভেতরে এবং বাইরে একটা চক্র ছিল যারা প্রকল্প নেওয়া, প্রকিউরমেন্ট এমন কি মন্ত্রণালয়ের ভেতরে কর্মকর্তাদের বদলী, পদোন্নতি সব নিয়ন্ত্রণ হতো তাদের মাধ্যমে। এখন এমন একটা চক্র যেখানে থাকে সেখানে তো প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনো কিছু হবে না। যে অগ্রগতি আপনি চান তা কখনোই সেখান থেকে আসবে না।

তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ যাচ্ছে এবং বৈদেশিক অর্থনীতিতে যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার বড় কারণ অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ। তার দায়ভার এ সরকারকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। আগের সে উদ্যোগ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আগামী দিনে অবকাঠামো খাতে এমন কিছু সংস্কার দেখতে চাই, যেগুলো মানুষ দেখতে পায়। যার ধারাবাহিতা অন্য কোনো সরকার এসে কাজ করে যেতে পারে।

আলোচনায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, উড়াল সড়ক মানেই ছোট গাড়িকে অনুপ্রাণিত করা। আর ছোট গাড়ি শহরে ঢুকলে যানজট বাড়ায়। সব ধরনের মানুষ এ শহরে থাকবেন সে চিন্তা করেই নগর পরিকল্পনা করা হয়নি। আগের সরকারের সময়ও আমরা এসব কথা বলতাম, তারা শুনেই শেষ করে দিতেন। যারা উন্নয়ন করবেন তারাই ওপেন সিক্রেট সুযোগ পেতেন অনেক বেশি যে কারণে প্রকল্পে গড়মিল দেখলে তারা কখনো তার প্রতিবাদ করতেন না। এরা শুধু গাড়িই নয় পরিবার নিয়ে বিদেশ ভ্রমণেও যেতেন বার বার। যে পরিমাণ ধস নামিয়ে গেছে, সেখান থেকে টেনে কতটুকু তুলতে পারবে এ সরকার তা আমি জানি না। তিনি এ খাতে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি সুপারিশ করেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. আকতার মাহমুদ বলেন, একটা ইকোনোমিক ক্যাডার ছিল, সেটা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। সেখানে কি করে ভালো কিছু পাবেন। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে যে কারণে ব্যয় বাড়ে। আর তা হয় কেবল ব্যক্তির ইচ্ছায়। সুনির্দিষ্ট। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেই বলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সমগ্র বাংলাদেশকে একটি ভৌত পরিকল্পনা করা উচিত। যা হয়েছে তা কেবল অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউজক) উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এখানে বোর্ড সদস্য কে বা কারা হন। এখানেও সংস্কার হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেও তার সংস্কারের সুপারিশ করা হয়। ফুটপাথ কেটে ছোট করা হয়েছে এগুলো জনবিরোধী কাজ। যে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে তা গাড়ি কেন্দ্রিক, জনকেন্দ্রিক নয়। বাস রেশনালাইজেশন করতে গিয়ে পারেনি। ৫৩ বছর পার হয়েছে হাওড়, পাহাড় চরাঞ্চলে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়নি। বর্তমান সরকার এ সকল দিকে নজর দেবে বলে আশা প্রকাশ করছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রধান আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মেহেদি এইচ ইমন জোর দিয়েছেন অবকাঠামোর পরিবেশগত দিকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে বাংলাদেশে। আর সেটা করে গেছে শেখ হাসিনা সরকার। দেশের অবকাঠামো করতে গিয়ে ঋণে জর্জরিত হয়েছে। তিনি শুধু ব্যাংক ডাকাতিই না ছোট ছোট শিল্প কারখানাগুলো ধ্বংস করে গেছেন। এখান থেকে এ সরকার নিশ্চয়ই টেনে তুলতে পারবে। আর এটাই হবে চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনা সরকার শিল্প কারখানাও ধ্বংস করে গেছে। প্রতিটি জেলায় শিল্প নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠিত কারখানা যেন ধ্বংস না হয় সে সুপারিশ করেন মাহিন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক উমামা ফাতিমা বলেন, উন্নয়নের নামে সকল সেক্টর একদম ধ্বংস করে গেছে। আজ ঢাকা শহর উড়াল সড়ক। কোনো রাস্তা নেই। আজ জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে। সরকার কখনো এ সমস্যা সমাধান করতে চায়নি। গত ১৫ বছরে যা হয়েছে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কোনো প্রকল্পের তথ্য প্রমাণ জনগণের কাছে ওপেন করেনি। জনগণের টাকায় নেওয়া প্রকল্প জনগণ কেন জানবে না? অন্য কোনো দেশের সঙ্গে প্রজেক্ট শেয়ার করে উন্নয়ন না করে সমস্যার গভীরে গিয়ে কাজ করতে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০২৪
জিসিজি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।