ঢাকা: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানের লক্ষ্যে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি অধিবেশনে বক্তব্য রাখবেন।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন জানান, প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর শুরু হতে যাওয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের সাধারণ বিতর্ক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। এ অধিবেশনে যোগদানের জন্য আগামী ২২ সেপ্টেম্বর একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে নিউইয়র্কে পৌঁছাবেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ বছর জাতিসংঘের ৮০তম বর্ষ পূর্তি হচ্ছে। জাতিসংঘের তিনটি মূল স্তম্ভ-শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার সবই সমানভাবে এবারের অধিবেশনে গুরুত্ব পাবে। বিশ্বব্যাপী আস্থার সংকট, সংরক্ষণবাদের উত্থান, বহুপক্ষীয় কূটনীতি এবং আলোচনার পথ উপেক্ষা করার ফলে সৃষ্ট যে তীব্র সংকট থেকে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটছে, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির পাশাপাশি উদ্ভূত নানারকম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপের বিষয়ে সার্বিক আলোচনার ক্ষেত্রে এবারের প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত অর্থবহ।
এ বছর অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এবার ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির সভাপতিত্বে রোহিঙ্গা বিষয়ক শীর্ষক একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ কর্তৃক সাধারণ পরিষদে এমন একটি উচ্চ পর্যায়ের সভার আয়োজন এবারই প্রথম।
উল্লেখ্য, গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধান উপদেষ্টা প্রথমবারের মতো সকল অংশীদারের অংশগ্রহণে জাতিসংঘ কর্তৃক এমন একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা আয়োজনের প্রস্তাব করেন। প্রধান উপদেষ্টার এই প্রস্তাব দ্রুত বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সর্বসম্মতিক্রমে একটি রেজুলুশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির নেতৃত্বে উক্ত উচ্চ পর্যায়ের সভাটি আয়োজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই উচ্চ পর্যায়ের সভা থেকে যেন রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধানের একটি কার্যকর ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা উঠে আসে, তার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদার ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গত মাসে (২৪–২৬ আগস্ট ২০২৫) আমরা কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো একটি অংশীদারদের সংলাপের আয়োজন করি।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে কক্সবাজারে একসাথে ইফতার করেছিলেন। প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন নতুন সংকটের উত্থানের পরেও সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে রোহিঙ্গা সংকট যে বিশ্বব্যাপী আলোচ্যসূচি থেকে পিছিয়ে পড়েনি-প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের সভার আয়োজন এবং স্বয়ং জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর তারই প্রমাণ। আমরা এ উচ্চ পর্যায়ের সভার সফল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
উপদেষ্টা জানান, এ ছাড়া এ বছর একই সাথে বিশ্ব যুব কর্মসূচির ৩০ বছর পূর্তি এবং নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক ঐতিহাসিক রেজুলুশনের ২৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। যুবদের নিয়ে আয়োজিত একটি উচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সভায় প্রধান উপদেষ্টা অংশগ্রহণ করবেন। ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্ট মাসে সংঘটিত যে গণঅভ্যুত্থানের কারণে আমরা আজ এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তার অগ্রভাগে ছিল মূলত দেশের তরুণ ও যুব সমাজ। এছাড়া চলমান নানামুখী সংস্কার কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থেকে অন্যতম অনুঘটক হিসেবেও দেশের তরুণ সমাজ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্ব যুব কর্মসূচির ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের সভায় অংশগ্রহণ করে আমরা আমাদের তরুণ ও যুব সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারব। ভবিষ্যৎ বিশ্বের পরিকল্পনা যেন আমাদের তরুণ সমাজের চাহিদা ও আশা–আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, সে জন্য বিশ্বমঞ্চে এই সংক্রান্ত আলোচনায় আমাদের উচ্চ পর্যায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। অন্যদিকে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে।
আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ আলোচনা পর্বে বক্তব্য রাখবেন। তিনি তার বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতার আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে বিগত এক বছরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সংস্কার ও আগামী দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশগুলো হতে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর, এবং সর্বোপরি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস তার বক্তব্যে উঠে আসবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের স্বাগত অভ্যর্থনা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জনাব ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যর্থনাসহ এ সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। আসলে, এ সময়ে অনেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তেও হয়ে যায়। সে বিবেচনায় নতুন বৈঠক তালিকায় যোগ হতে পারে; আবার সময়ের অভাবে কোনো বৈঠক বাদও যেতে পারে।
এবারের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে আমিও বেশ কয়েকটি ইভেন্টে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করব।
তৌহিদ হোসেন জানান, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকারের বর্তমানে অন্যতম অগ্রাধিকার হল জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা এবং সুষ্ঠুভাবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। এ প্রেক্ষাপটে এবারের অধিবেশনে আমাদের কাছে একটি সুযোগ-বিশ্বদরবারে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত আমাদের চলমান সংস্কার কার্যক্রম এবং গণতন্ত্র অভিমুখে আমাদের যাত্রাকে উপস্থাপন করা।
উপদেষ্টা আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার পরিচিতি এবং সুনাম বিশ্বব্যাপী। এ কারণে অনেকগুলো বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
জাতিসংঘের এবারের অগ্রাধিকারের ইস্যুগুলোর প্রত্যেকটিই বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুগুলোর ওপর যেসব ইভেন্ট আছে, বাংলাদেশ তার সব কয়টিতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করছি। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মনে করে।
সার্বিক বিবেচনায় এবারের অধিবেশনে উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিস্তৃত ও সুদৃঢ় হবে বলেও আশা করেন তৌহিদ হোসেন।
টিআর/এসআইএস