ফরিদপুর: ফরিদপুরের ভাষা সৈনিক মোল্যা জাকির হোসেন ওরফে ননী মোল্যা (৭৯) বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ২৭ মার্চ ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়’।
‘ফরিদপুর জিলা স্কুল ছাড়া সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালন করে।
‘যে আশা বুকে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছিলাম তা বাস্তবায়িত হয়নি। ’
‘বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষ নিজের ভাষা ভুলে ভিনদেশিদের ভাষার চর্চা করে। ’
বাংলানিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘দেশ আজও শত্রুমুক্ত হয়নি। আর যারা বুকে বাঙালি চেতনা ধারণ করেনি তারা এদেশে থেকে এদেশকে ধ্বংস করতে আজও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ’
শহরের আলীপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জিয়ারত হোসেন মোল্যার ছেলে জাকির হোসেন মোল্যা ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে ফরিদপুর হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন।
বাবা মারা যাওয়ার পর নানা সংকটে আর লেখাপড়া করা হয়নি তার।
১৯৪৮ সালে ননী মোল্যা ফরিদপুর হাই স্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।
সেই সময়ের ছাত্র ধর্মঘট প্রসঙ্গে ননী মোল্যা বলেন, ‘রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্ররা সেদিন মিছিল নিয়ে তাদের স্কুলে আসে। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ইমামউদ্দিন আহমাদ, সাংবাদিক লিয়াকত হোসেন, মনোয়ার হোসেন, মহিউদ্দিন প্রমুখ। তাদের কেউ আর এখন বেঁচে নেই’।
জিলা স্কুলের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি থানা মোড়ের ওয়ারেন্টেল প্রেসের সামনে গেলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। তাতেও মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়নি। পরে জেলখানার সামনে থেকে ফের মিছিলে লাঠিচার্জ করা হয়।
এতে থানার সামনে থেকে রওশন খা ও জেলখানার সামনে থেকে মাজাহারুল হক (সূর্য মিয়া) আহত হন। মিছিল থেকে আটক করা হয় সৈয়দ মাহাবুব আলী, মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল হালিমসহ কয়েকজনকে।
ওই দিনই ফরিদপুর ঝিলটুলী পাওয়ার হাউজের সামনে থেকে ইমাম উদ্দিন আহমাদ ও আব্দুল বারিকে আটক করা হয়।
ছাত্র নেতাদের আটক করার প্রতিবাদে শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়। কিন্তু জিলা স্কুল কর্তৃপক্ষ ধর্মঘট করতে দেয়নি বরং যে ছয় শিক্ষার্থী ধর্মঘটের আহ্বান নিয়ে স্কুলে গিয়েছিল তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়।
পুলিশ যখন স্কুল থেকে ওই শিক্ষার্থীদের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল তখন স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয় এবং এতে ছাত্রনেতারা শহীদ হন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে এ খবর শুনে আমরা শহরে মিছিল করি। এই মিছিলে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়’।
এর দুই তিন দিনের মধ্যে শহরের অম্বিকা ময়দানের পূর্ব পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সে সময়ে শহীদ মিনার সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা না থাকায় ভাষা সৈনিক আব্দুস শুকুরের পরিকল্পনায় ইট-সিমেন্ট দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এটাই ফরিদপুরের প্রথম শহীদ মিনার।
ননী মোল্যা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতা বিরোধীরা ওই শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। স্বাধীনতার পরে শহীদ মিনারটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৪ সালে এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে ফরিদপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার করা হয়’।
ননী মোল্যা পরবর্তি সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী, স্বাধীনতা সংগ্রাম, আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্য, আন্দামান ফেরত বিপ্লব এবং বামপন্থি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ মোজাফ্ফর) যোগদেন। বর্তমানে দেশের চলমান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন তিনি। বর্তমানে তিনি শহরের আলীপুরে স্ত্রী, ৫ ছেলে ও নাতী-পুতিদের নিয়ে অবসর জীবন যাপন করছেন।
বাংলা ভাষা চর্চার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আজও বাঙাল রয়ে গেছি, বাঙালি হতে পারিনি। ’
তিনি বলেন, ‘ভিনদেশি সংস্কৃতির ভীরে আজ দেশীয় সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। যে কোনো মূল্যে দেশের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা হবে’।
জীবনের শেষ ইচ্ছা হিসেবে দেশের মানুষের কাছে বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা করা আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, নিউজরুম এডিটর /মতামত জানাতে ইমেইল করুন: [email protected]