ঢাকা, সোমবার, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

এখন শোকই অজয় রায়ের শক্তি

কানে বাজে, ‘বাবা, তুমি গ্রেট!’

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
কানে বাজে, ‘বাবা, তুমি গ্রেট!’ ছবি: জিএম মুজিবুর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ব্লগার ছেলে অভিজিৎ রায় খুন হয়েছেন, বিচারের জন্য আকুল হয়ে আছেন বাবা অজয় রায়। প্রতিটি মূহূর্তে ছেলের স্মৃতি যেন ছবি হয়ে চোখের সামনে ভাসে।

চোখ ভরে জলে, আবার দৃঢ় হয়ে ওঠেন একা-একাই। শোক পরিণত হয় শক্তিতে। ছেলে হত্যার বিচার তাকে পেতেই হবে।

১২ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ছিলো অভিজিৎ রায়ের জন্মদিন। এদিনই বাংলানিউজকে বেশ খানিকটা সময় দিলেন অধ্যাপক অজয় রায়। রমনায় তার নিজ বাসায় বসে কথা হচ্ছিলো।

অধ্যাপক ড. অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা।

আলাপের শুরুতেই অভিজিৎ হত্যার তদন্ত বিষয়ে বললেন, ‘আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে- সবকিছু মোটামুটি ঠিকভাবেই চলছে। তবে গতি আরেকটু বাড়ালে ভালো হয়। ’

‘তদন্ত বা বিচার ঢিমেতালে হলে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়,’ অভিমত এই অধ্যাপকের।

‘মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, অভিজিতের বিষয়টি তারা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে এবং বেশ গুছিয়ে এনেছে,’ আশ্বস্ত কন্ঠে বলেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতটা সিরিয়াস? সে প্রশ্ন এখনো উঁকি দেয় তার মনে। তবে নিরাশ নন। বললেন, কিছু অপরাধী ধরা পড়েছে। আশা করি, সত্য বেরিয়ে আসবে।

গত বৃহস্পতিবার (১০ সেপ্টেম্বর) নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ‘প্রধান' মো. আবুল বাশারসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গ উঠতে জানা গেলো প্রতিটি আপডেটই রাখছেন ড. অজয় রায়। তিনিই জানালেন, তদন্ত থেকে জানা গেছে, পাঁচ জনকে অভিজিৎ হত্যায় অ্যাসাইন করা হয়। তবে আসল হত্যাকারী দুই জন।

ড. রায় বলেন, পুলিশ, ডিবি আরও তদন্ত করবে- এরা ইনভলভ কিনা। এরপর বিচার। শুনেছি একজন নাকি জামিন আবেদনও করেছে।

ছেলের হত্যাকারীদেরসহ অন্যান্য হত্যার ঘটনায় দোষীদের ব্যাপারে তার নিজেরও কিছু ভাবনা রয়েছে।

অধ্যাপক অজয় রায় মনে করেন, কিছু গোষ্ঠীকে এখনই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, গোষ্ঠীগুলো মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান, কাশ্মিরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পায়। ওসব স্থানে সশস্র প্রশিক্ষণও পায়। আমাদের দেশের মাদ্রাসা
ছাত্রদের নিয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আর তারাই দেশে ফিরে বিভিন্ন সংগঠনের নামে এসব কাজ করে। আর ইসলামী ছাত্র শিবিরতো আগে থেকেই সক্রিয়। এদের নিষিদ্ধ না করলে দেশের এই সন্ত্রাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে বেগ পেতে হবে।

এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে নৃশংসভাবে খুন হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, গুরুতর জখম হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

ধীরে ধীরে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন এই পিতা। ছেলের স্মৃতি আওড়ান তিনি, বলেন, ‘অভিকে খুব মিস করি। শুধু ছেলে বলে নয়, সে প্রতিভাবান একজন মানুষ ছিল। একটি স্টেজের পরে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হয় বন্ধুত্বের। আমি সবাইকে বলতাম, অভি মেধায় আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। এটাই আমার
গর্ব। ’

দেয়ালে টাঙানো অভি-পরিবারের ছবি দেখান। নাতনী তৃষার ছবি দেখিয়ে বলেন, অভিমান করেছে। এদেশে আর আসবে না। তার প্রিয় বন্ধু অভিজিৎকে হারিয়ে বাচ্চাটি অভিমানী হয়ে পড়েছে।

হঠাৎ একটু গম্ভীর কন্ঠ, বলেন, ‘আমি এখানেই থাকবো। নিজের দেশ ছেড়ে কোথায় যাব? বাস্তবতা মেনে নেব। রিয়েলিটি ফেস করতে চাই, পালাতে চাই না। ’

‘১৯৭১’র ১২ সেপ্টেম্বর অভিজিতের জন্ম। ওর জন্মের সময় আমি কুমিল্লায়, যুদ্ধ করছি। এক ভলান্টিয়ার এসে জানালো, বাবা হয়েছি। তারও ১৫/২০ দিন পর অভিকে দেখলাম, হাসপাতালে একটি বেবিকটে শুয়ে বুরবুর করে তাকিয়ে, কোলে নিলাম…’ জল ভরা চোখেও হাসেন অজয় রায়।

পরপরই নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিয়ে জানালেন, ‘এবারের জন্মদিনে অভির লেখাসমগ্র, তার জীবনী নিয়ে অনেকের লেখা, বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা নিয়ে অনলাইনে একটি আয়োজন করছে মুক্তমনা। এগুলো পরের বইমেলায় বই আকারে আসবে। ’

অজয় রায় বলেন, হুমায়ুন আজাদের পর অভির ঘটনাটিও খুব আলোড়ন তুলেছে। এখন জানি, অভিকে আসলে ওরা অনেক আগেই টার্গেট করে রেখেছিল। তার সম্পর্কে তারা পূর্ণ তথ্য নিয়েছে। ১৬ তারিখ দেশে এলো সে। ৫ জনের মনিটরিং টিম তাকে ফলো করছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি তারা সুযোগ পেয়ে গেল। এর আগেও চেষ্টা করেছে, পারেনি।

‘এমন জায়গায়, এত মানুষ, পুলিশের কাছাকাছিতে মেরে ফেললো, তারা ধরা পড়লো না কেন বুঝলাম না,’ সংশয় অজয় রায়ের কণ্ঠে।

সোফা ছেড়ে ওঠেন ড. অজয়, দেওয়ালে দুই সন্তানের ছবিটি দেখিয়ে বলেন, ‘ফুলার রোডে থাকতাম। ওরা বড় হচ্ছিল। একবার ক্রিকেট ব্যাটের
আবদার করলো, যেদিন নিউমার্কেট থেকে ব্যাট কিনে দিলাম, এত্ত খুশি হল!’

‘অভিকে ডাকতাম গুল্লু। গুল্লু নেই, কিন্তু তার সেদিনের একটি কথা কেবলই কানে বাজে। ব্যাট হাতে সেদিন বেজায় খুশিতে বলেছিল, ‘বাবা, তুমি গ্রেট!’

হাসেন অজয় রায়, চোখ আবারও জলে ছলছল।

বাংলাদেশ সময় ১০১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।