ঢাকা: বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে পরিচালিত অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে অপারেশন ক্লিনহার্ট চলার সময়ে ক্ষতিগ্রস্তরা চাইলে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন অথবা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেও ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন বলে উল্লেখ করেছেন আদালত।
এ বিষয়ে রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে রোববার (১৩ সেপ্টেম্বর) এ রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এই প্রথম কোনো দায়মুক্তি আইনকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, যৌথবাহিনীর ওই অভিযানের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন এবং হাইকোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন।
রায়ে আরো বলা হয়, সংসদ এ ধরনের দায়মুক্তির আইন করতে পারেন না। সংসদকে এ ধরনের এখতিয়ার সংবিধান দেয়নি। শুধুমাত্র ইচ্ছাকৃত নয় এমন ঘটনা ঘটলেই দায়মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। মানুষের মৌলিক অধিকারের দিকে খেয়াল রেখে সংসদকে আইন পাস করতে হবে। জন্মই যার মৃত তার কোনো ভিত্তি নাই। সুতরাং এ আইন থাকতে পারে না।
আদালত আরো বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে হত্যার পর খুনিদের দায়মুক্তি দিতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ করা হয়েছিল। এ নিয়ে কেউ উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেননি। এটা দু:খজনক। এ আইনের কোনোটি নিয়ে কেউই কোনোদিন রিট করেননি, যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। এই প্রথম কোনো দায়মুক্তির আইন নিয়ে রিট আবেদন করা হলো।
কেউই আইনের উর্ধ্বে নয় উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজ হাতে আইন তুলে নিতে পারেন না। সংবিধান অনুযায়ী একজন শীর্ষ অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে কারো মৃত্যুকে জঘন্য অপরাধ বলেও পর্যবেক্ষণে বলেন আদালত।
রুলের চুড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৩১ আগস্ট হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ রায়ের জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী এম মনজুর আলম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
রায় শেষে আইনজীবী শাহদীন মালিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘রায়ে দু’টি কথা বলা হয়েছে। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে যৌথবাহিনীর অভিযানে হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দিয়ে যে আইনটি তা অসাংবিধানিক ও বাতিল। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার চাইতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে আজ একটি নতুন দ্বার উন্মোচন হলো।
তিনি বলেন, যে যতো বড় অপরাধী হোক না কেন, অপরাধীরা আইনের উর্ধ্বে নয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন-২০০৩’ এর মাধ্যমে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তৎকালীন সরকার সংসদে আইন পাস করে সেগুলোর বৈধতা দেয়। আজ তা বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।
এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আইনটিকে কেন সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই রুলটি জারি করেন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ। একই সঙ্গে ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও রুলে জানতে চাওয়া হয়।
আইন, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র সচিব, সেনা সদর দফতরের কমান্ডার ইন চিফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে ছয় সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলে। ওই অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ জারি করা হয়।
এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না ২০১২ সালের ১৪ জুন হাইকোর্টে রিট আবেদনটি করেন।
সে সময় ড. শাহদীন মালিক বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। ওই আইনের ১৪ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে ও এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। ফিলিপাইনে এটা করা হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও এ ধরনের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে অনেক রায় দিয়েছেন। যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়।
রিট আবেদনকারী জেড আই খান পান্না বলেন, ওই আইনে বলা হয়, অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করা যাবে না। এটা সংবিধানের মৌলিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নির্যাতিত হবে, খুন হবে কিন্তু প্রতিকার চাওয়া যাবে না—এর চেয়ে কালো ও খারাপ আইন হতে পারে না। কোনো সভ্য দেশে এ ধরনের আইন থাকতে পারে না। বিচারবহির্ভূত যেকোনো হত্যাকাণ্ড আইনের শাসনের পরিপন্থী। এ কারণে আইনটি চ্যালেঞ্জ করে রিটটি করা হয়।
দীর্ঘদিন পর রিট দায়েরের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় লেগেছে। পাশাপাশি সমমনা মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে ও সময়োপযোগিতা বিবেচনা করে রিটটি করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৫
এজেডকে/এএসআর