ঢাকা, রবিবার, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

জনবল ও বাজেট সংকট

খুঁড়িয়ে চলছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা

সাইফুর রহমান, ডিভিশনাল স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫
খুঁড়িয়ে চলছে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রংপুর: জনবল সংকট, অপর্যাপ্ত বাজেট ও লোহা চুরি সিন্ডিকেটের দৌরাত্মের কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না দেশের সর্ববৃহৎ রেলওয়ে কারখানা ‘সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা’।

নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলায় স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের শ্রী হারিয়ে এখন চলছে অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।



দেশীয় এ কারখানায় মালবাহী ওয়াগন, যাত্রীবাহী কোচ ও ইঞ্জিন মেরামত ও তৈরির সব রকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ‍নানা কারণে তা হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে ওয়াগন ও কোচ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে কারখানাটি ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সরকারের আশু সুদৃষ্টি প্রয়োজন।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা সূত্র জানায়, ১১০ একর জমির ওপর কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত। নির্মাণ সামগ্রী রয়েছে ২০ একর জমির ওপর। কারখানার ভিতরে মিটারগেজ রেললাইন রয়েছে ২৮ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ও ব্রডগেজ রেললাইন ১১ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। এছাড়া ডুয়েলগেজ রেললাইন রয়েছে ২৭ দশমিক ৮ কিলোমিটার।
 
কারখানাটির ক্রমভগ্নদশার অন্যতম কারণ হিসেবে রয়েছে জনবল সংকট। কারখানায় যান্ত্রিক বিভাগের ২ হাজার ৮৪৭ জনের বিপরীতে রয়েছেন ১ হাজার ১৪৪ জন। বৈদ্যুতিক বিভাগে ৩৩৭ জনের বিপরীতে রয়েছেন ১৭৫ জন। চিকিৎসা বিভাগে ১৫৩ জনের বিপরীতে রয়েছেন ৮৬ জন। পূর্ত বিভাগে ৭৫ জনের বিপরীতে রয়েছেন ৪৬ জন। সরঞ্জাম বিভাগে ৩০৬ জনের বিপরীতে রয়েছেন ৯৪ জন। আরএনবি বিভাগে ১১৩ জনের বিপরীতে ১০১ জন। রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষক ২৫ জনের জায়গায় রয়েছেন ১৮ জন। মোট ৩ হাজার ৮৫৬ জনের বিপরীতে রয়েছেন ১ হাজার ৬৬৪ জন।
 
এদিকে, কারখানার বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতিও দীর্ঘদিনের পুরোনো। এ নিয়েও কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। ৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো যন্ত্রপাতি রয়েছে ৩৮৩টি। ২০ হতে ৫০ বছরের পুরোনো রয়েছে ২০৫টি। ২০ বছরের পুরোনো রয়েছে ১৫৪টি।

দেশের বৃহৎ এ রেলওয়ে কারখানায় তৈরি হয় রেলের নানা ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশ। এসবের মধ্যে রয়েছে ২৩৬ প্রকারের ওয়াগনের যন্ত্রাংশ, ১২৬ প্রকারের ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ ও বিবিধ ২৪৯ প্রকারের যন্ত্রাংশ।

বছরে এ কারখানায় ৩১০ টি কোচ ও ২৬৪টি ওয়াগন মেরামত করা সম্ভব। কিন্তু লোকবল সংকট ও কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লোহা চুরির প্রবণতা অব্যাহত থাকায় সামর্থ্য অনুযায়ী কোচ ও ওয়াগন মেরামত করা যাচ্ছে না।

তবে গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ কারখানায় মোট ১৮১টি কোচ ও ৩৯৫টি ওয়াগন মেরামত করা হয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে ২০৬টি কোচ ও ৪৮৬টি ওয়াগন মেরামত করা হয়েছে।

২০১১-১২ অর্থবছরে ৩০২টি কোচ ও ৬৩০টি ওয়াগন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩০২টি কোচ ও ৬১১টি ওয়াগন মেরামত করা হয়।

এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৬৮টি কোচ ও ৫৪২টি  ওয়াগন এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩১০টি কোচ ও ৬৬০টি ওয়াগন মেরামত করা হয়।

২০০৯ হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কারখানা থেকে মোট ২ হাজার ১৯৭টি ওয়াগন-ব্রডগেজ কোচ এবং ২ হাজার ৮১৩টি মিটারগেজ কোচ সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে সামর্থ্যের চেয়েও বেশি পরিমাণে ওয়াগন মেরামত করা সম্ভব হয়েছে।

এছাড়া ২০১৫ সালের ঈদুল ফিতরে ৫৯টি ব্রডগেজ কোচ ও ২৫টি মিটারগেজ কোচ সরবরাহ করা হয় এ কারখানা থেকে।

আসন্ন ঈদুল আজহায় ব্রডগেজ কোচ ৪৫টি এবং মিটারগেজ কোচ ২০টিসহ মোট ৬৫টি কোচ সরবরাহ করা হবে।  

এদিকে, কারখানায় দায়িত্বরত ও সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা লোহা চুরির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারখানার এক কর্মচারী জানান, ওই সিন্ডিকেটের ‍মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি টাকার লোহা কারখানা থেকে চুরি হয়ে যায়। এই সিন্ডিকেটে সিবিএ নেতা থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত রয়েছেন।

অপরদিকে, চাহিদা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না এ কারখানার। এর জন্য ‍অবশ্য অপর্যাপ্ত বাজেট অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানান, কোনো অর্থবছরেই চাহিদামতো বাজেট পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রাপ্ত অর্থেই কোনোরকমে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

সূত্র জানায়, গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কারখানার চাহিদা ছিল ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, কিন্তু পাওয়া যায় ১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

একইভাবে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৯ কোটি টাকার চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যায় ১৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৫ কোটি টাকার বিপরীতে পাওয়া যায় ১৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।

এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ২৮ কোটি টাকা, পাওয়া যায় ১৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চাহিদা ৩২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা হলেও বরাদ্দ দেওয়া হয় ২২ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা বাংলানিউজকে জানান, জনবল সংকট ও বাজেট ঘাটতির কারণে কারখানা কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে যেতে পারছে না। তবে এখন কারখানাতে লোহা চুরি নেই বলে তিনি দাবি করেন।

সৈযদপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) নূর আহম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, অনেক চেষ্টা করেও চাহিদা অনুযায়ী বাজেট পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া জনবল সংকটের কারণেও কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

তিনি অনুরোধ করে বলেন, ‘ভাই একটু লেখালেখি করেন যাতে আমাদের দেশে কোচ ও ওয়াগন বেশি বেশি তৈরি হয়। এতে বিদেশ থেকে বেশি অর্থ খরচ করে কোচ ও ওয়াগন আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। ’

১৮৭০ সালে ওয়াগন ও বাষ্পচালিত ইঞ্জিন মেরামতের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। ১৯০৩ সালে উৎপাদনে যায় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯২৬ সালে ব্রডগেজ রেললাইনের গাড়ি মেরামতের জন্য কারখানার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৫৩ সালে ভারী যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে পুনঃকার্যক্রম চালু করা হয়।

১৯৬৬ সালে কারখানাটি বগি ও ওয়াগন নির্মাণ শপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৯৩ সালে কারখানার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে আধুনিকায়নের মাধ্যমে কারখানাটি ফের চালু করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৫
এসআর/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।