নৌ-সার্কুলার রুট ঘুরে: নিশ্চিত সংঘর্ষের আশঙ্কায় নিমিষে সতর্ক সবাই। ব্রিজের গায়ে ওয়াটার বাসের মাস্তুলটা ধাক্কা খেলো বলে! খোলা হাওয়া গায়ে মাখাতে ছাদে উঠে বসা জনা পনেরো শিল্পী, সাংবাদিক, আলোকচিত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।
কিন্তু লোহার ব্রিজটার মাত্র এক কি দুই ইঞ্চি দূরে থাকতে পানিতে একটু যেনো জাম্প করলো ওয়াটার বাসের মাথা। পিছিয়ে এলো দু’তিন ফুট।
ফেলে আসা পথে একটু আগে রূপগঞ্জ সেতুতে আরো একবার নিশ্চিত সংঘর্ষ বাঁচিয়েছিলেন ওয়াটার বাস-৫ এর মাস্টার নুর হোসেন সুমন। সে দফা বাসের মাথায় খাড়াভাবে স্থাপিত মাস্তুলের বাল্ব খুলে ধীর গতিতে ব্রিজটির নিচ নিয়ে পার হওয়া গিয়েছিলো বটে। কিন্তু সেটা ছিলো মাত্র ইঞ্চি ছয়েকের মামলা। এবার মাস্তুলের ফুট আড়াই আটকে গেলো ইছাপুরা ব্রিজে।
![](files/River_01_974633536.jpg)
বালু নদীর ওপরে কোনো ব্রিজ নির্মাণ করা হলে বিধি অনুযায়ী তার ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স থাকার কথা ২৫ ফুট। অর্থাৎ, ভরা বর্ষা মৌসুমে পানির যে সর্বোচ্চ উচ্চতা তার চেয়ে ব্রিজের পাটাতন থাকবে ২৫ ফুট উপরে। কিন্তু ইছাপুরা ব্রিজে এই উচ্চতা ১১ ফুটেরও কম।
পূর্ব তীরে রূপগঞ্জের ঈছাপুরা, পশ্চিম পড়ে খিলক্ষেত থানার পূর্ব সীমানা। উভয় পাড়েই লোডশেডিং। অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে ব্রিজের নিচে। এই সন্ধ্যা সাতটাতেই বালু নদীর কালচে জলের ওপরে গাড় আঁধার। দু’পাড়ে বিভিন্ন দোকানে তেল-সলতের টিমটিমে আলো। ব্রিজ পার না হতে পেরেই বোধ হয় আরো ক’টি নৌযান নোঙর করা ব্রিজের কাছে।
বাধ্য হয়ে তীরে ভেড়ানো হলো ওয়াটার বাস। বিশাল এক বাঁশের মাচার ওপরে সম্ভবত নতুন আড়ৎ হচ্ছে নদীর ওপরে। সেই মাচার নিচ দিয়ে ঘাড় নিচু করে উঠতে হলো তীরে। এ যেনো দখলদারিত্বের কাছে মাথা নিঁচু করেই তীরে ওঠা।
ফোনে ‘ভয়ানক সার্ভিস’ জন্য বিআইডব্লিউটিসি’র এজিএম (ঢাকা ঘাট) বরকত উল্লাহকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির মাঠ কর্মী আহমেদ মুনিরুদ্দিন তপু। তার বলার ভঙ্গী উপভোগ্য হয়ে উঠে সবার কাছে।
![](files/River_02_325579974.jpg)
তবে ব্রিজ বিড়ম্বনায় পড়ে যাত্রা সাঙ্গ হলো। কথা ছিলো টঙ্গী খাল আর তুরাগ নদী হয়ে বাদামতলীতে গিয়ে শেষ হবে চক্কর। একযাত্রায় পাড়ি দেওয়া হবে ঢাকার নৌ সার্কুলার রুট। কিন্তু সে আশায় গুঁড়ে বালি। সকালে প্রায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে বাদামতলী থেকে ছেড়ে আসা ৮৩ সিটের ওয়াটার ট্যাক্সি বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষা হয়ে বালু নদীর এই অংশটাতে এসে আটকে গেলো।
যার যার মতো ফেরত গেলেন সাংবাদিক মুরশেদ আলী খান, মাহমুদা চৌধুরী, মুন্নী সাহা, তরুণ সরকার, রাজিব নূর, ফারজানা রূপা, শামীমা বিনতে রহমান, বোরহানুল হক সম্রাট, জাহানারা পারভীন, রাইসুল ইসলাম, হৈমন্তী শাহনাজ চৌধুরী, ওয়ালিদ শিকদার, চিত্রশিল্পী শরিফ আল মাসুদুর রহমান, শাহিনূর রহমান, ইসরাত জাহান, আলোকচিত্রী শেখ হাসান, জয়িতা রায়, সংস্কৃতিকর্মী কবির হোসেন তাপস, লেখক ওয়ালিদ শিকদার, রাজু, সৌমিক ইসলাম অতনু প্রমুখ।
আরো আগে পথে নেমে যাওয়ায় অবশ্য ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট সভাপতি অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ এবং অনুবাদক-গবেষক মওলানা নুরুদ্দিন ফতেহপুরীসহ আরো ক’জন এই বিড়ম্বনা থেকে বেঁচে গেলেন। ওয়াটার বাস থেকে লাভ দিয়ে নামতে গিয়ে আহত হয়ে নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জ ঘাট থেকে ফেরত গেছেন স্থপতি সাজ্জাদুর রাশেদ।
আটকে পড়া ওয়াটার বাসটি ফেরত গেলো। নারায়ণগঞ্জে নামবেন বলে একমাত্র যাত্রী হিসেবে তাতে রয়ে গেলেন সাংবাদিক শরিফ উদ্দিন সবুজ।
![](files/river_03_937340904.jpg)
তরুণ সরকারের ‘আক্রান্ত নদী আক্রান্ত জলাভূমি’ বই এর তথ্য অনুযায়ী, ইছাপুরা ব্রিজ ছাড়াও পানির সর্বোচ্চ স্থর থেকে টঙ্গী খালের ওপরে নির্মিত কামারপাড়া ব্রিজ ও টঙ্গীর দুই রেল ব্রিজের উচ্চতা মাত্র ৮ ফুট করে, টঙ্গী রোড ব্রিজের দুটিরই উচ্চতা ১০ ফুট করে এবং ডেমরা ব্রিজের উচ্চতা ১১ ফুট। পানির সর্বোচ্চ স্তর থেকে সব ক’টি ব্রিজের উচ্চতা নির্ধারিত ২৫ ফুটের অর্ধেকেরও কম।
বালু, টঙ্গী ও তুরাগ নদীর ওপর নির্মিত এই ব্রিজগুলোই ঢাকার চারিপাশে নৌ-সার্কুলার রুট চালুর ক্ষেত্রে প্রধান বাধা। এসব ব্রিজ রেখে কিছুতেই সার্কুলার ওয়াটারওয়ে চালু করা সম্ভব হবে না। ঢাকার উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে এমন ব্রিজের সংখ্যা অন্তত ১৭টি। যেগুলোর দু’তিনটি বাদে আরা কোনোটারই নির্মাণে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। এগুলোর মধ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগ অন্তত ৮/৯টি, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর অন্তত ৬টি এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে অন্তত দু’টি ব্রিজ নির্মাণ করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জোর করে এসব বিধি পরিপন্থি ব্রিজ নির্মাণ করেছে বলে অভিযোগ আছে বিআইডব্লিউটি- এর পক্ষ থেকে।
সরেজমিনের দেখা গেলো, বালূর ইছাপুরা ব্রিজ থেকে আশুলিয়া ব্রিজ পর্যন্ত অন্তত ৫টি সেতুর নিচ দিয়ে বড় ওয়াটার বাস ট্যাক্সি পার হওয়া সম্ভব নয়। টঙ্গী-ব্রিজ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৪৪ সিটের ছোট ওয়াটার ট্যাক্সি চলতে পারে বটে, কিন্তু বড়গুলোর পক্ষে কিছুতেই এসব ব্রিজের নিচ দিয়ে ওয়াটার বাস পার হতে পারবে না।
![](files/River_04_177644666.jpg)
কিন্তু বিআইডব্লিউটিসির উর্দ্ধতন কারো কাছেই বিষয়টি পরিষ্কার বলে মনে হয়নি। ঢাকার সার্কুলার নৌ-রুটে প্রাচীন স্থাপত্য পরিদর্শনের জন্য ওয়াটার ট্যাক্সি বরাদ্দ নিতে সশরীরে যোগাযোগ করা হয় বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) ফারুক আহমেদ, জিএম শাহাদত হোসেন, জিএম শাহাদত হোসেন, এজিএম (যাত্রী পরিবহন ইউনিট) আজমল হোসেন, এজিএম (ঢাকা ঘাট) বরকত উল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে। দফায় দফায় দেখা করা হয় ওয়াটারবাস-৫ এর মাস্টার সুমনে সঙ্গে। ফোনে যোগাযোগ করা হয়- মিজানুর রহমানের সঙ্গে।
বালু নদীতে থাকতেই সাংবাদিক মুর্শেদ আলী খান একবার ফোন করেন চেয়ারম্যানকে। তিনি তখন জানান, নৌ-মন্ত্রীর সঙ্গে চাঁদপুরে আছেন।
কিন্তু তারা কেউই ইছাপুরা ব্রিজে এসেই আটকে যেতে হতে পারে বলে কোনো পূর্বাভাস দিতে পারেননি। তারা জানিয়েছিলেন, টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত ওয়াটার ট্যাক্সি যাবে। সেখান থেকে ট্রলারে আশুলিয়া ব্রিজ পার হয়ে উঠতে হবে ওয়াটার বাস-৪এ। কিন্তু টঙ্গী ব্রিজের অনেক আগেই ওয়াটার বাস আটকে যায়। সাঙ্গ হয় কর্মসূচি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫
জেডএম
** ঢাকার নৌ-সার্কুলার রুটে প্রাচীন স্থাপত্য পরিদর্শন
** ‘ঐতিহ্য রক্ষায় নদী দখলমুক্ত করতে হবে’
** ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্য ও নদ-নদী পরিদর্শনে গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি
** ঢাকার বৃত্তাকার নৌপথে প্রাচীন স্থাপত্য ও নদনদী পরিদর্শন শনিবার