ঢাকা, বুধবার, ২৮ মাঘ ১৪৩১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

চামড়ায় ধরা মৌসুমী ব্যবসায়ী!

রহমান মাসুদ ও মফিজুল সাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
চামড়ায় ধরা মৌসুমী ব্যবসায়ী! ছবি : দীপু মালাকার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: কোরবানির পশুর চামড়া কিনে এবার ধরা খেয়েছেন মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা। চামড়া শিল্পের তিন সংগঠনের নির্ধারিত দামের বাইরে প্রতিযোগিতা করে চামড়া কিনে তারা ধরা খেয়ে লোকসানের মুখে পড়েছেন।



এখন ট্যানারি ও পোস্তার ব্যবসায়ীদের কাছেকম দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। যদিও ঘোষিত মূল্যে চামড়া কিনছেন না কেউই। ঢাকার চামড়ার দাম ঠিক হয়েছিল, প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। সেখানে পোস্তার আড়ৎদার ও হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনছেন ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে। তারপরও লোকসান গুণছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।

লোকসানে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর ধানমণ্ডি শঙ্করের আবিদ হাসান ফয়সাল। অন্যান্য সময় ঘুরে বেড়ান। তেমন কোনো কাজ করেন না। কিন্তু কোরবানির ঈদের সময়টায় চামড়া ব্যবসায়ী বনে গেছেন। কোরবানির প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে প্রায় আড়াইশটি চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। তিনি প্রতিটি চামড়া কিনেছিলেন এক হাজার ৫শ থেকে দুই হাজার ২শ টাকা দরে। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে পোস্তার আড়ৎ ও ট্যানারি মালিকদের কাছে যে দাম পাচ্ছেন, তাতে মানভেদে প্রতি চামড়ায় ১ থেকে দুইশ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুণতে হচ্ছে তাকে।

আবিদ বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয় ভাই-ব্রাদারের কাছ থেকে যে দামে চামড়া সংগ্রহ করেছি, সেই দামেও চামড়া নিতে চায় না পোস্তার আড়ৎ ও ট্যানারি মালিকেরা।
 
তিনি বলেন, প্রতি চামড়াতে এক থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে।

একই অবস্থা সেগুনবাগিচার ওয়াহিদুজ্জামানের। তিনি ঈদের দিন ১৬০টি চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। প্রতিটা চামড়া গড়ে এক হাজার ৮শ থেকে দুই হাজার ২শ টাকা দরে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু লালবাগের পোস্তায় ও হাজারীবাগের ট্যানারিতে এসে লোকসানে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে প্রায় ৭০ হাজার টাকা লোকসানে।
 
বাংলানিউজকে ওয়াহিদু্জ্জামান বলেন, ১৬০টি চামড়ায় ৭০ হাজার টাকা ‘নাই’ হয়ে গেছে। আমাদের (মৌসুমী ব্যবসায়ী) লোকসান খাওয়ানোর জন্য পোস্তার  ‍আড়ৎদার ও ট্যানারি মালিকেরা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। আমাদের যেহেতু সংগ্রহের উপায় ও উপকরণ নেই, তাই বিপদে ফেলে এই সিন্ডিকেট কম দামে চামড়া সংগ্রহ করছে।
 
মালিকদের দোষারোপ করলেন আড়ৎদাররা
তবে চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে একে অপরকে দোষারোপ করছেন। লালবাগ পোস্তার আড়ৎদাররা এজন্য ট্যানারি মালিকদের দোষারোপ করছেন। তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহ করছেন ট্যানারি মালিকেরা। অথচ বছরখানেক আগে পোস্তার আড়ৎ থেকে চামড়া কিনে এখনও দাম পরিশোধ করেনি ট্যানারি মালিকেরা। অথচ সরকার তাদের ৬০০ কোটি টাকা লোন দিয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ না করে তারা নিজেরাই মহল্লায় লোক পাঠিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছেন। আমাদের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৫৫ টাকা। অথচ তারা নিজেরা কিনছেন ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।

রাজধানীর পলাশী, পুরান ঢাকার ধোলাইখাল, সায়েন্সল্যাব, লালবাগের পোস্তায় গিয়ে দেখা গেল, দ্বিতীয় দিনের মতো চামড়া সংগ্রহ চলছে মহাব্যস্ততায়। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এখানে চামড়া বিক্রি করছেন। এরপর লবণ দিয়ে পোস্তার আড়তে চামড়া সংগ্রহ করা হচ্ছে। আবার এ সব পয়েন্টে ট্যানারি মালিকরা নিজেরা চামড়া সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন ট্যানারিতে। তবে অতিরিক্ত গরমে প্রথমদিন প্রচুর চামড়া নষ্ট হওয়ার তথ্যও মিললো এখানে।

কোরবানির দিন থেকে শুরু হওয়া চামড়া সংগ্রহ চলবে রোববার পর্যন্ত। তবে উত্তরবঙ্গ, নাটোর ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশ থেকে সব সময়ই চামড়া আসবে পোস্তায়। পোস্তার আড়তে প্রতিটি গরুর চামড়া সংগ্রহ করতে দুইশ টাকা এবং ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করতে ৪০ টাকা খরচ হয় আড়ৎদারদের। লবণ, শ্রমিক, পরিবহন, ঘরভাড়া ও  চামড়াপ্রতি এ টাকা খরচ হয়।
 
পোস্তার আড়ৎদার আব্দুল আজিজ বাংলানিউজকে বলেন, ট্যানারি মালিকেরা আমাদের ঋণ পরিশোধ করেননি। অথচ তারা আমাদের ঋণ না দিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেই টাকায় চামড়া কিনছেন।

হাজারীবাগের গুলশান ট্যানারির মালিক আনসারুল হক বাংলানিউজকে বলেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা নিজেই লোকসানের পথ বেছে নিয়েছেন। আমরা আগেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। তারা কেন অতিরিক্ত দামে চামড়ার সংগ্রহ করেছেন?

আপনারা কি সেই দামে চামড়া কিনছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঠিককরা দামে তো চামড়া মিলছে না। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বেশিদামে চামড়া কিনে আমাদের বিপদে ফেলেছেন। আমাদের ৭০/৮০ টাকা দরে চামড়া কিনতে হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর ঘোষিত দাম অনুযায়ী, এবার ঢাকায় কোরবানি হওয়া গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে গরুর চামড়া ৪০-৪৫ টাকা, প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ২০-২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫-১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ট্যানারি মালিকরা যা বলছেন-
সরেজমিন দেখা গেছে, অতিরিক্ত দামে চামড়া সংগ্রহ করছেন প্রায় সব ট্যানারি মালিকই। প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া গড়ে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে কিনছেন তারা। দেড় হাজার থেকে শুরু করে তিন হাজার ৫শ টাকা পর্যন্ত একেকটা চামড়া কিনছেন তারা।

কেবল মৌসুমী ব্যবসায়ী বা পোস্তার আড়ৎদারই নন, নির্ধারিত দামে আস্থা নেই ট্যানারি মালিকদেরও। তারা বলছেন, শুধুমাত্র চামড়ার বাজার নিয়মের মধ্যে রাখার জন্যই নামমাত্র চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়। প্রতিবছরই এ নিয়ম ভাঙা হয়। অথচ সেই লোকদেখানো দামের দোহাইতেই কুপোকাত মৌসুমী ব্যবসায়ীরা।

একই সঙ্গে কোরবানির চামড়ার টাকার যারা হকদার, সেই সব দুস্থদেরও কপাল পুড়লো এবার। গত বছর যে চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার টাকা, এবার তা বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৫শ টাকা দরে। কোরবানিদাতারা চামড়ার দাম ভালো পেলে দুস্থদের সাহায্যের পরিমাণও বেড়ে যেতো।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
আরএম/এমআইএস/এবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।