ঝালকাঠি থেকে ফিরে: হাতে দুধরাজ। কখন খোলস ছেড়েছে কে জানে।
বড়সড় বিষধর সাপ হাতে সুমন বাংলানিউজকে বললো, ভয় পাই না তো। সাপে ভয়ের কিছুই নাইগা। বড়ই হইসি সাপ লইয়া খেলা করতে করতে। স্কুলে যাওয়া হয়নি? উত্তরে সুমন, স্কুল গিয়া করমু কী, সাপ লইয়াই তো ভালো আছি...।
![](files/September2015/September29/Gypsies_Jhalokathi__26__216597642.jpg)
এই হলো অবস্থা। তারও আগের কথায় এলে- শারদীয় মেঘে আকাশ মেঘলা ছিল বাদ যায় না সে প্রসঙ্গ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও হয়েছে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মাচা আকারে অবয়ব তৈরি, তার ওপর ত্রিপল। এই ছোট্ট তাবু সংসার। ঝিরি ধারাপাতের বৃষ্টিতে মাথা গুঁজে ছিলেন তারা। থামলো বারিশ, বেরিয়ে এলেন। এর একজন যেমন সুমন, তেমনি দুধরাজও।
![](files/September2015/September29/Gypsies_Jhalokathi__15__713487404.jpg)
সাপে রোমাঞ্চ খোঁজা শিশু সুমন জানে না তার ভবিষ্যৎ কী। সে চিন্তা মাথায় নেই কারোই। উপস্থিত জনতা কম নয়, ভালোই জমায়েত। তবে সবাই বাসিন্দা। ১৫ ঘর বেদে এখানে। প্রশ্ন ছিল শিশু সুমনের অভিভাবকদের কাছে। তবে জবাব নেই কারো কণ্ঠেই। গলায় বিষধর সাপ পেঁচিয়ে এখানে বড় হয়ে ওঠা সুমনের জীবন যে আরও কত পেঁচানো এমনটি কেউ ভেবে দেখেনি কখনও!
![](files/September2015/September29/Gypsies_Jhalokathi__5__538494956.jpg)
সময়ের সঙ্গে বেদেদের পেশায় আসছে পরিবর্তন। নানামাত্রিক কারণেই এমনটা হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে খাপখাওয়ানোর মতো মন-মানসিকতা এখনও তাদের গড়ে ওঠেনি। ফলে এই শিশুদের ভবিষ্যৎ সাপ! শুধু সমুন তো নয়- সে একটি প্রতীকী মাত্র। তার মতো এমন আরও অনেক শিশু পল্লীতে আছে যারা অাজন্ম শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, যেন সত্যিই দেখার কেউ নেই।
![](files/02_Gypsies_Jhalokathi_859171829.jpg)
ততক্ষণে সাপটি লুঙ্গি পড়া জাহিদের হাতে। সুমনের তুলনায় জাহিদ বয়সে বড়। ১২ বছর। লুঙ্গির কাপড়ে মুখ টেনে ধরে দেখানোর চেষ্টা দুধরাজের বিষধর দাঁত। তখনই ফেলা তুললো সরীসৃপ প্রাণীটি। ঝাপটে দিলো টান। গড়ালো মাটিতে, মূহুর্তেই পেছোনের ঝোঁপ-ঝাড়ে পালিয়ে যাওয়া চেষ্টা...। খপ করে সুমনের হাত। হয়ে গেলো ধরাসাই। ফের সুমন গলায় জড়ালো সাপটিকে। এই কাব্য তাদের রোজকারই।
ঝালকাঠি জেলা শহরের কলেজ মোড় মাঠে বাস সুমন-জাহিদের। ১৫টি বেদে পরিবারে তিন ঘরে সাপ আছে বর্তমানে। কথা হয় দুধরাজের সাপুড়ে রিপনের সঙ্গে। পান খাওয়া দাঁত আর বড় বড় মুখ মোচকানিতে শব্দ-বাক্য উচ্চারণ তার। বাংলানিউজকে জানালেন, চলতি বছর অগস্টের শেষ দিকে দুধরাজ সাপটি ধরেছেন জেলার গাবখান জঙ্গল থেকে। এ ধরনের সাপ বিরল। পাওয়াও যায় না খুব একটা। এটিকে এখনও বিষমুক্ত করা হয়নি। বাক্সে রাখা হয়েছে পোষ মানবে বলে। আসলে কি পোষ মানে? রিপনের উত্তর, ঢাকায় যাবে সাপটি। তাই বাক্সে রেখে একটু ঠাণ্ডা রাখছি।
![](files/03_Gypsies_Jhalokathi_200468782.jpg)
রিপন আরও বলেন, সাপটি বেশ বড়। দুই-একবার খেলা দেখানো হয়েছে। গ্রামে বা জেলা শহরে এই মূল্যবান সাপ দিয়ে খেলা দেখিয়ে লাভ কম, তাই এটিকে ঢাকায় পাঠানোর চেষ্টা। সেখানে গুরু সরদাররা চেয়েছেন। মূলত সাপ আমারা গ্রাম থেকে ধরি, পরে তা রাজধানী ঢাকায় উচ্চ দরে খেলা দেখানোর জন্য চলে যায়।
তবে বিষয়টি কতটুকু যুক্তিসংগত বা আইনি সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই সাপুড়ে রিপনের কাছে। উল্টো পরিবেশ-প্রতিবেশ অনেক বদলে গেছে মত দিয়ে তিনি জানান, এখন আর সাপ তেমন একটা পাওয়া যায় না। মানুষ সাপের আবাস নষ্ট করেছে। বনবাদার নেই তাই সাপও নেই। ১৫ ঘরের ছোট্ট এই বেদেপল্লীতে মাত্র তিন ঘরে সাপ আছে, তাও একটি করে। আগে তো প্রতি ঘরেই ছিল। যাদের সাপ নেই তারা অন্য টুকটাক কাজ করে খান।
![](files/September2015/September29/Gypsies_Jhalokathi__17__521970013.jpg)
এই পল্লীতে শিশুর সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫ জন। কেউ স্কুলে যায় না, শেখে না পড়াশোনা। এ বিষয়ে সাপুড়ে রিপন বলেন, পড়ে লাভ কী! আমার তো ছেলে আছে, সঙ্গে থাকে। কাজ-কাম শেখে। খালি পড়লে তো সংসার চলবে না। আর পড়লে তো সময় নষ্ট!
![](files/04_Gypsies_Jhalokathi_116648967.jpg)
সুযোগ পেলেও কি পড়াশোনা করাবেন না? উত্তরে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সুযোগ যদি পেতামই তবে দেশ স্বাধীনের পর থেকেই হতো। এতো বছরেও যা হয়নি, তা এখন হবে বিশ্বাস করি না। এ কথা শুনে এগিয়ে এলেন মো. জালাল সরদার। তিনি পল্লীর সহকারী সরদার। বাংলানিউজকে বললেন, কয়েক মাস হলো আমার ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়েছি। এর একটি কারণ আমি পরিবার নিয়ে অনেক দিন ধরে এই এলাকায় থাকছি। অন্যরা পল্লীতে স্থানী নন, তাদের আসা-যাওয়ার জীবন। ফলে কেউ তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুল কিংবা মাদ্রাসায় পাঠাতে আগ্রহী নন, সম্ভবও হয় না। আমিই পল্লীতে একমাত্র ব্যক্তি যার সন্তান শিক্ষার আলোয় আছে।
![](files/September2015/September29/05_Gypsies_Jhalokathi_956707482.jpg)
তিনি বলেন, সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন থেকে কেউ আমাদের সহযোগিতা করে না। যদি করা হতো, বা সারাদেশের বেদেদের নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হতো তবে সত্যিই উপকৃত হতো শিশুরা, শিশুদের ভবিষ্যৎ এবং সর্বপরি দেশ। এ বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
আগের মতো এখন আর নয়। একটা সময় ছিল যখন সাপুড়েদের বড় বড় চুল, লম্বা গোঁফ, কাঁধে গেরুয়া কাপড়ের ঝোলা, হাতে বীণ, মাথায় সাপের ঝাঁপি থাকতো। সময়ের সঙ্গে এসব বদলে গেলেও বদলায়নি তাদের শিক্ষার হালচাল। বেদেরা স্থায়ী নয়। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে ঘুরে জীবন-যাপন তাদের। তাই ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানো যায় না- এমন বক্তব্য অনেকের। বেদেরা যে যেখানে এখন অবস্থান করছেন, তাদের সেখানে রেখেই শিক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে ফল আসবে, এমন মতও উঠে আসে।
![](files/06_Gypsies_Jhalokathi_395297581.jpg)
বেদে পরিবারে বাল্য বিয়ে ও বহু বিয়ের প্রবণতা বেশি। মেয়ে শিশুদের বয়স ১৪ কি ১৫ হলেই বিয়ে দেওয়া হয়। মূলত বিয়েও হয় নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যেই। পুরুষ সদস্যদের চেয়ে তারা ঢের পরিশ্রমী।
ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড়ের বেদেপল্লীর এসব শিশুদের কখনও যাওয়া হয়নি স্কুলে। যাওয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নবান ছুড়ে দিয়েও তো লাভ নেই। সাধারণ বয়স যে পেরিয়েছে কবেই। যাদেরও বা রয়েছে সুযোগ চট করে স্কুলে ঢু মারার তাদের তো ভবিষ্যৎ সাপ! সাপ নিয়েই দিনরাত্রি! সাপেই দিনরাত্রি!
এমন তালিকায় শিশু সাকিব (১৬), মো. দীপু (১৪), শাকিল (১২), হৃদয় (১০), নীপু (০৭), নূপুর (০৬), সম্পদ (০৫), শাকিলা (০৪) আরও কত নাম।
![](files/September2015/September29/07_Gypsies_Jhalokathi_328423980.jpg)
এর মধ্যে নূপুরের বক্তব্য, আমাগো তো আর স্কুল নাইগা! কী করুম, একখানে গিয়া নৌকায় ভাইসা বেড়াই, আরেকখানে ডাঙায়। আর সারাদিন তো খেলি সাপ নিয়া! মনিরাজ গাছের পাতা খাইসি আমাগো সবাই। তাই সাপে কাটলেও কিচ্ছু হবে না।
তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? কী হতে চাও বড় হয়ে? -হিহিহি, কী যে কন- লক্ষ্য আবার কী জিনিস! ভবিষ্যৎ মানে সাপ- হিহিহি! আপনিই শুধু বলতাসেন, আর কেউ কয় না...!
চলবে... (দ্বিতীয় পর্ব)
বাংলাদেশ সময়: ০১৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০০, ২০১৫
আইএ
** প্রধানমন্ত্রীকে অনেক ধন্যবাদ
** যেখানে হারায় না শৈশব
** তিন মাস চা বিক্রেতা, নয় মাস মজুর
** ‘আমড়া বন্ধনে’ সম্ভাবনা বিশ্ব ছোঁয়ার
** জ্যাম-জেলি, পেয়ারা ও ভাসমান হাটে আগ্রহ
** রাস্তায় ইট বিছিয়ে ব্যবসা
** ঢাকায় কেজি ৪০, এখানে মণ ৪০!
** এই পেয়ারার স্বাদই আলাদা!
** নৌকায় ভাসা বিশাল বাজার...
** থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম নয় ‘ভীমরুলী’