রাজাপুর (ঝালকাঠি) থেকে: মৃত্যুঝুঁকি এখন অনেকটাই কম। তবে দেশে ফেরার মতো সুস্থ হননি বাবুল।
সোমবার দুপুরে রাজাপুরের বাইপাস মোড়ে দেখা হয় সাহেব আলীর সঙ্গে। এরপর অটোতে করে পুটিয়াখালি মাদ্রাসার সামনের রাস্তায়। সেখান থেকে সাহেব আলীর পেছনে পেছনে প্রায় ২০ মিনিটের মতো হাঁটতে হলো। মাটির রাস্তায় জোয়ারের পানি উঠেছে বেশ কয়েকটি স্থানে। জুতো না খুলে সে বাড়িতে প্রবেশ সম্ভব নয়।
বাড়ির ঠিক সামনের পুরো ৬ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। জমিটুকু দেখিয়ে কেঁদে উঠেন তিনি। যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে রাখা জমিটুকু মাত্র ৭২ হাজার টাকায় ছেড়ে দিয়েছিলেন।
উঁচু মাটির ভিটের ওপর বহুদিনের পুরনো ইটের দেয়াল। তবে সেখানে কোনকালেই পলেস্তারা পড়েনি সিমেন্টের। কোনরকমে মাথার ওপরে টিকে আছে টিনগুলো। উচ্চতা কমে এসেছে ঘরের।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে মালযেশিয়ার জোহরবারুতে একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে ঝালাইয়ের কাজ করতে গিয়ে ফসকে পড়েন বাবুল। গ্যাসের মিশ্রণের ওপর পড়ে শরীরের ৪০ শতাংশ অংশ পুড়ে যায় তার। এক বিপত্নীক চাইনিজ লি ইয়ং কি'র মহানুভবতায় ধীরে ধীরে এখন সুস্থতার পথে বাংলাদেশি এ যুবক। মালয়েশিয়ার অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা তেনেগানিতাও সাহায্য করছে বাবুলকে।
![](files/babul1_727153922.jpg)
দুই এতিম সাহেব আলী এবং ফাতেমাকে বিয়ে দিয়েছিলো গ্রামবাসী। দিনমজুরি আর কৃষি কাজ করেই চলতো তাদের সংসার। কথা হয় বাবুলের মা ফাতেমার সঙ্গে।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, প্রথম সন্তানকে অনেক কষ্ট করে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করানো হয়েছিল। তবে বিয়ে করে পরিবারের সঙ্গে সর্ম্পক ছিন্ন করে সে। বড় মেয়ে মাজেদার বিয়ে দিয়েছেন পাশের গ্রামে।
মেঝো ছেলে বাবুল ২য় শ্রেণির পর আর লেখাপড়া চালায়নি। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ায় স্কুলের চৌকাঠই মাড়ায়নি ছোট ছেলে ফোরকান।
দিনমজুরের কাজ করতেন বাবুলও। এরপর টেম্পুর হেলপারের কাজ করেন কিছুদিন। ধীরে ধীরে চালনাটাও শিখে যান। এ সময় টেম্পুর মালিক বাবুলকে প্রথম প্রস্তাব দেন মালয়েশিয়া যাওয়ার। তবে সে সময় ভরসা পাননি ফাতেমা।
কিছুদিন পর সাহেব আলীর দূর সর্ম্পকের চাচাতো ভাই চান মিয়া একটি কলিং ভিসা আছে বলে জানান। এ জন্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ করতে হবে। এবার কিন্তু পুরো পরিবার লেগে পড়েন টাকা যোগাড়ে।
সাহেব আলী জানান, বাড়ির সামনের ভিটাটুকু বিক্রি করেন ৭২ হাজার টাকায়। আর ক্ষেতের জমি ৪ কাঠা বিক্রি করেন ৪০ হাজার টাকায়। গ্রামের ফিরোজা নামে এক নারীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ করেন ২৫ হাজার টাকা। পরবর্তী প্রতি মাসে ৪ হাজার টাকা করে ১০ মাসে সুদসহ ৪০ হাজার টাকা শোধ করতে হয় পরিবারটিকে।
বসতভিটা বন্ধক রেখে রাজাপুর সোনালী ব্যাংক থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেয়া হয়। এছাড়াও চান মিয়া ধার দেন ৭০ হাজার টাকা।
![](files/babul2_788795964.jpg)
টাকা এভাবে যোগাড় করা হলেও মালয়েশিয়া যেতে দেখা দেয় বিপত্তি। চান মিয়া জানান, বাবুল মালয়েশিয়া পৌছে গেছেন। তবে বাবুল এ সময়টায় বৌবাজারে ঠেলাতে কাজ করছিলেন। ৫ মাস পর মালয়েশিয়া পৌছেও বুঝতে পারেন, কথা রাখেনি এজেন্ট। চালক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও, সেখানে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে।
২০১২ সালে মালয়েশিয়া যান বাবুল। প্রথম বছর বৈধভাবে আয় করেন। এ সময়টায় বিক্রি করা জমি ছাড়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে ধার নেয়া টাকার বড় অংশটি শোধ করেন তিনি।
ফাতেমা জানান, বাবুল ফোন দিয়ে বলতো- এখানে কাজ করতে ভাল লাগে না। ড্রাইভারির কথা বললেও অন্য কাজ করায়। আর যা আয় করি, তা দিয়ে খাওয়া-থাকার পর কিছু বাকি থাকে না।
বাড়তি আয়ের আশায় মালয়েশিয়ায় কর্মস্থল পরিবর্তন করেন বাবুল। তারপরই দুর্ভাগ্য নেমে আসে জীবনে। অবৈধ হয়ে পড়েন তিনি। এর মাঝেই ঘটে দুর্ঘটনাটি। পুরো পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ে। সাহেব আলী ও ফোরকানের দিনমজুরির টাকায় শোধ করা হয় আরো কিছু ধার।
তেনেগানিতার আশ্রয়ে থাকা বাবুলকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে কাঁদতে থাকেন ফাতেমা।
তবে সংস্থাটির সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার আশিকুর রহমান খান বাংলানিউজকে বলেন, এখন বাবুলের যে শারীরিক অবস্থা, তা বাড়ি ফেরার মতো নয়। আমি তাদের বাড়ি দেখেছি, তাকে হুইল চেয়ারে করে আনলেও ঘরে ঢোকানো সম্ভব নয়। এছাড়া সেখানে বিদ্যুৎ নেই, অথচ বাবুলকে সার্বক্ষণিকভাবেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখতে হয়।
এছাড়াও মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা চিকিৎসা খরচ রয়েছে বাবুলের- যা পরিবারটির পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৫
এমএন/জেডএম