আমতলী থেকে ফিরে: কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেশীয় প্রজাতির আইড় মাছ চাষ ও প্রাকৃতিক নিয়মে পোনা উৎপাদন করে মৎস্য চাষিদের মধ্যে সাড়া ফেলেছেন বরগুনার আমতলী উপজেলার সফল মৎস্য চাষি আব্দুল জব্বার। হয়েছেন উপজেলার শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষি।
বর্তমানে তিনি মাছ চাষে মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন গোটা এলাকায়। তার পরামর্শে এলাকার অনেকেই দেশি প্রজাতির আইড় মাছ চাষ শুরু করেছেন। দূর-দূরান্ত থেকেও মৎস্য চাষিরা আসছেন তার কাছ থেকে আইড় মাছের পোনা সংগ্রহ করতে। আবার কেউ আসছেন বড় আইড় মাছ কিনতে।
![](files/September2015/September30/Barguna_Air_Fish_News_pic_02_387857367.jpg)
আমাদের দেশের হাওড়-বাওড়, নদী, খাল-বিল ও পুকুরে এক সময় প্রচুর আইড় মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু পরিবেশ এবং মানুষ সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে আইড় মাছের উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের ২৬০টি প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে ১২টি জাত চরম বিপন্ন ও ১৪টি জাত সংকটাপন্ন। এই সংকটাপন্ন মাছের মধ্যে অন্যতম আইড় মাছ। দেশি প্রজাতির এই আইড় মাছের চাষ ও প্রাকৃতিক নিয়মে পোনা উৎপাদন করে জব্বার দৃষ্টি কেড়েছেন সবার।
সরেজমিনে আমতলী উপজেলার শারিকখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, আইড় মাছ সংগ্রহের জন্য মৎস্য পাইকারদের উপস্থিতি। আইড় মাছ গভীর পানির হওয়ায় জাল ফেলে পুকুরে ডুবে ডুবে এ মাছ ধরতে হয়। জব্বারসহ তার ঘেরে কাজ করা সবাই পুকুরে নেমে এক একটি ডুবে এক একটি মাছ তুলছেন। কোনটা সাইজে বেশ বড় আবার কোনটা ছোট। ছোট মাছগুলো ছেড়ে দিয়ে বড় মাছগুলো রাখছেন বিক্রির জন্য।
![](files/September2015/September30/Barguna_Air_Fish_News_pic_01_980210785.jpg)
পুকুর পাড়ে উপস্থিত কলাপাড়া থেকে আসা মৎস্য পাইকার দেলোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, আইড় মাছ খেতে সুস্বাদু। বাজারে এটার চাহিদাও অনেক। কিন্তু পাওয়া যায়না বললেই চলে। তাই জব্বার ভাই'র এখানে মাছ বড় হলেই আমরা চলে আসি ক্রয় করার জন্য। আবার অনেক সময় বড় বড় অনুষ্ঠানে আইড় মাছের কথা বলা হয়। তখন না দিতে পারলে কাস্টমার হাতছাড়া হয়ে যায় তাই আগে ভাগেই জব্বার ভাইয়ের কাছ থেকে মাছ সংগ্রহ করে রাখি।
শুধু দেলোয়ারই নন এরকমই অনেকেই আসছেন জব্বারের কাছে মাছ ক্রয় করতে। আবার কেউ কেউ আসছেন চাষের জন্য মাছের পোনা সংগ্রহ করতে।
মাছের পোনা ক্রয় করতে আসা বরগুনার মৎস্য চাষী কালাম বাংলানিউজকে বলেন, আইড় মাছ চাষ লাভজনক। এ মাছ সাধারণত পাওয়া যায়না। আমার পরিচিত একজনের কাছে এখানে আইড় মাছের পোনা আছে শুনে আমি কিনতে এসেছি। এ বছর প্রথম পোনা ছাড়ছি তাই অল্প কিছু কিনবো। সফল হতে পারলে ব্যাপক জায়গা জুড়ে এ মাছের চাষ করবো।
![](files/September2015/September30/Barguna_Air_Fish_News_pic_09_390199838.jpg)
সফল মৎস্য চাষী আব্দুল জব্বার বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৯৫ সাল থেকে নিজস্ব জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষ শুরু করি। প্রথমে রুই, কাতলা, মৃগেল ও পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষে সফল হয়েছি। পরে ভাবলাম দেশীয় প্রজাতির নদী ও সাগরের মাছ যদি চাষের আওতায় নিয়ে আসা যায় তবে কেমন হয়।
যেই ভাবা সেই শুরু। পার্শ্ববর্তী পায়রা নদীর জেলেদের কাছ থেকে প্রথমে চারটি আইড় মাছের পোনা এনে একটি নির্দিষ্ট পুকুরে ছাড়লাম। এক বছরে মাছগুলো বেশ বড় হলো। পরে সেই মাছ ডিম দিলে শুরু হয় পোনা উৎপাদন প্রক্রিয়া।
আইড় মাছ গভীর পানির হওয়ায় তারা গর্ত করে ডিম পারে। সেই ডিম থেকে পোনা আসে। পরে বড় আইড় মাছের পুকুর থেকে পোনাগুলো আলাদা করে অন্য একটি পুকুরে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে পোনাগুলো বড় হলে বিক্রিযোগ্য পোনা রেখে বাকিগুলো নিজের পুকুরে চাষ করি।
বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও আইড় মাছের ঘেরসহ তার এখন ২০টি পুকুর রয়েছে। এখানে আট জন কর্মচারী কাজ করেন। তারা এ মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল।
![](files/September2015/September30/Barguna_Air_Fish_News_pic_08_240243287.jpg)
তিনি আরো বলেন, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ধারনার উপর ভিত্তি করে কাজ করেছি। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আইড় মাছকে টিকিয়ে রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
ওয়ার্ল্ড ফিশ বরগুনার কর্মকর্তা সমীরণ দত্ত বাংলানিউজকে বলেন, আইড় মাছ জলাশয়ের তলদেশে থাকতে পছন্দ করে। এ কারণে এরা তলদেশের খাদ্য গ্রহণ করে। এরা জলজ উদ্ভিদ, ছোটো মাছ এবং অন্যান্য বড় মাছের পোনা খায়। এরা গ্রীষ্মকালে ডিম ছাড়ে। এই সময় এরা জলাশয়ের তলদেশে গর্ত করে ডিম রাখে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর, অন্যান্য জলজ প্রাণীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য পাহারা দেয়।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপালের মিষ্টি পানিতে আইড় মাছ বেশি পাওয়া যায়। থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ও চীনের ইয়ুনান প্রদেশে এই মাছ অল্পবিস্তর পাওয়া যায়। এই মাছ লম্বায় প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রায় মাছের মধ্যে এই মাছটি অন্যতম। তাই এটিকে টিকিয়ে রাখতে চাষের কোনো বিকল্প নেই।
![](files/September2015/September30/Barguna_Air_Fish_News_pic_05_836160053.jpg)
জেলার ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা আলফাজ উদ্দিন শেখ বাংলানিউজকে বলেন, আইড় মাছ এক সময় নদী-খালে প্রচুর পাওয়া যেত। এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এ মাছটি। বিলুপ্ত প্রায় এ মাছটি চাষে সহায়তা ও টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৫
এমজেড