ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

বসে আছি কি আর করা...

সালাহ উদ্দিন জসিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
বসে আছি কি আর করা... ছবি: শাকিল / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ঘরির কাটায় রাত ০২ টা। হাইকোর্ট মাজার গেটে বসে আছেন চল্লিশোর্ধ এক নারী।

তীব্র শীতে যবুথবু হয়ে আছেন। একটু কাছে গিয়ে- ঘুমান না কেন খালা? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই বাচ্চাদের দিকে ইশারা করে উত্তর করলেন, ‘দুইটা কম্বল, দুই ছেলেরে শুয়াইছি। আমি বসে আছি, কি করবো?’

কথা বলে জানা গেছে, তার নাম হাজেরা বেগম (৪০)। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায়। গরীব বাবার ঘরে জন্ম। ভাই ছিল না। বাবা-মাসহ তিনবোনের সংসার ছিল। তিনবোনের বিয়ের পর বাবা-মা মারা যায়। বাড়ির ভিটামাটি চাচারা দখল করে নেয়। তিন বোন স্বামীর সংসারে থাকায় এ নিয়ে উচ্চবাচ্চ্যও করেননি।

অন্য বোনদের স‍ুখের সংসার হলেও ১০ বছর আগে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মারা যান স্বামী। তখন এক মেয়ে ও গর্ভে দুটি যমজ সন্তান ছিল হাজেরার। সেসময় শ্বশুর ‍বা বাবার বাড়ি কোথাও ঠাঁই না পেয়ে কয়েকদিন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় কাটে। পরে ঠাঁই হয় এই মাজার গেটে। সুখ-দুঃখের ১০টি বসন্ত-শীত-গ্রীষ্ম এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন।

মেয়েকে এখানে থেকেই বিয়ে দিয়েছেন। এখন যমজ ছেলে দুটি‘র বয়স ১০। তাদের কোনো এতিম খানায় দিতে পারলেই বাঁচেন হাজেরা বেগম।

আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘সরকার তো যায়গা-জমি দেয় শুনি, আমরা তো কিছুই পাই না। আমাদের কোনো গর্জিয়ানও (অভিভাবক) নাই, যাদের কাছে কিছু চামু, আবদার করমু। ’ খবার পান কই? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কেউ দিলে পাই, খাই। না হয় এভাবে পড়ে থাকি। ’

একটু সামনে এগুতেই দেখা যায়, ষাটোর্ধ আরেক নারী শীতে কাপছেন। কিছু বলার আগেই জিজ্ঞেস করলেন? একটা কম্বল দিবা? পরিচয় দিয়ে কথা বলে জানা গেছে, এই নারীর আরেক সংগ্রামী ইতিহাস।

আয়শা বেগম ষাটেরও বেশি বয়স। বরিশালের মুলাদী বাড়ি ছিল। নদী ভাঙনে বিলিন হয়ে গেছে ভিটা-বাড়ি। দীর্ঘ ২০ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এখানে। দুই ছেলে তার। বড় ছেলে কামরাঙ্গীরচর থাকে, ওখানেই কাজ করে খায়। ছোট ছেলে গাড়ি চালায় মাসে বেতন পায় পাঁচ হাজার। তার কিছু অংশ মাকে দেয়, বাদ বাকি দিয়ে নিজে চলে।

হাজেরা আর আয়শা বেগমদের মত বহু লোক রাজধানী ঢাকার হাইকোর্ট মাজার গেট, গুলিস্তান নাট্যমঞ্চের সামনে, শিল্পকলা একাডেমির ফুটপাত, সদরঘাটের বিভিন্ন স্পটে শুয়ে-বসে দিন-রাত নয় শুধু, জীবন পার করে দিচ্ছেন। বাসায় শীতের কাপড় পড়েও যখন শীত লাগে তখন ‍রাস্তায় থাকা শীত কাপড় ছাড়া মানুষগুলোর কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

কালেভদ্রে খাবার বা শীত কাপড় দিলেও বছরজুড়ে তাদের নিয়ে ভাবেন না কেউই। মাঝে মধ্যে দেওয়া খাবার বা শীতের কম্বল নিয়েও হয় জালিয়াতি। প্রকৃত অসহায় মানুষ খুব কমই পায় মানুষের দেওয়া খাবার বা কম্বল। ঘর-বাড়ি ও চাকুরি আছে এমন একটি চক্র গড়ে উঠেছে ওইসব এলাকায়।

হাজেরা বেগম জানান, এখানে যা মানুষ দেখেন,তার চারভাগের একভাগ অসহায়। বাকিদের সবকিছু আছে তারপরও রাতে এখানে আসে। বিশেষ করে শীত, ঈদ ও রোজায় তাদের দখলে থাকে এই এলাকা (হাইকোট ‍মাজার)। কেউ কম্বল দিতে আসলে হুড়াহুড়ো করে লুটে নেয়, পরে বিক্রি করে দেয়। এরকম হয় ঈদ ও রমজান মাসে।

তিনি বলেন, আমরা দৌড়াইতে পারি না। পাইও না। পাইলেও তারা জোর করে নিয়ে যায়।

ইরানে দেয়ালে দেয়ালে হ্যাঙ্গার ঝুলিয়ে শীত কাপড় সংগ্রহ করে অসহায়দের বিলানোর খবর প্রশংসিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে‍। বাংলাদেশেও তীব্র শীতে পাশে দাড়ানোর মানবিক আহ্বান আসছে, অসহায় শীতার্তদের কাছ থেকে। কোনো বাড়ি-গাড়ি নয়, শীত নিবারণে তারা আমাদের সহযোগিতা চায়। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব আমাদের।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
এসইউজে/বিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।