ঢাকা: পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্লোগান ‘যেখানে আপনার একটি স্বপ্ন আছে’। এ মন্ত্রণালয়ের ক্যানভাসে বার বার উঁকি দেয় নানা স্বপ্নও।
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট এ মন্ত্রণালয়েরই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে পদ্মাসেতু প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তখনও অনেকে এটাকে স্বপ্নই মনে করেছিলেন। উত্তাল পদ্মার বুকে আবার ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু? এটা হয় নাকি!কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে এ স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পরিমাণে ১ লাখ ৯৯৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য। যেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পদ্মাসেতুর জন্য সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এছাড়া ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২০১৪-১৫ অর্থবছরে।
বিদায়ী বছরে একনেক বৈঠকে ঢাকা নগরীতে পাতালরেলের স্বপ্ন দেখানোর পাশাপাশি কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এছাড়া সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অনুপস্থিতির কারণে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে একনেক বৈঠক থেকেই।
একনেক বৈঠকে আলোচনা ও সমালোচনায় ছিল সচিবালয় স্থানান্তর প্রকল্প ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজার সরানোর বিষয়টিও।
লাখ কোটি টাকা ছাড়ালো এডিপি
২০১৫ সালে লাখ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির(এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়, যেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ৯৭ হাজার কোটি টাকা মূল এডিপি এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব তহবিল ৩ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। এতে করে মোট এডিপির আকার দাঁড়ায় এক লাখ ৯৯৬ কোটি টাকা। এ এডিপি বাস্তবায়নকে বর্তমান সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।
আরও একটি স্বপ্ন পাতালরেল
পদ্মাসেতুর মতো আরও একটি স্বপ্ন দেখালেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেটি হলো ঢাকা শহরে পাতালরেল। যানজট নিরসনে ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি পাতালরেল প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশনা দেন।
২০১৫ সালে একনেক বৈঠক থেকেই শুরু হওয়া এ স্বপ্নও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যানজট নিরসনে ঢাকায় মেট্রোরেলের পাশাপাশি পাতালরেল প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাতালরেল প্রকল্প গ্রহণের জন্য শেখ হাসিনা পরিকল্পনা কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ফিরে গেল সচিবালয় স্থানান্তর প্রকল্প
২০১৫ সালে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল ‘ঢাকার শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সচিবালয় নির্মাণ’ প্রকল্প। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের মূল নকশার অভাবে প্রকল্পটি একনেক বৈঠক থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। লুই আই কানের মূল নকশা বাংলাদেশে না থাকায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়নি একনেক।
একনেক নির্দেশ দিয়ে বলেছে, প্রকল্পটি প্রণয়ণ করা হয়েছে লুই আই কানের অনুলপি নকশার ওপর নির্ভর করে। এখন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই আই কানের প্রধান নকশা নিয়ে আসতে হবে। কোনো অনুলিপি নকশার ওপর নির্ভর করে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া যায় না।
১৯৭৪ সালে ৪২ একর জায়গায় ১০টি ব্লকে চারটি নয়তলা ভবনসহ অফিস, ব্যাংক, অডিটরিয়াম, মসজিদ, কার পার্কিং ইত্যাদি সম্বলিত জাতীয় সচিবালয় নির্মাণের চুক্তি হয়েছিলো। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের নকশা স্থাপত্য অধিদফতর সংশোধন করেছে। কারণ, ইতোমধ্যে আগের জমির পরিমাণ ১০ একর কমে গেছে। ওই জমিতে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
এখন ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ভাঙ্গতে হবে অথবা জিয়াউর রহমানের মাজার সরাতে হবে।
জিয়াউর রহমান মারা যান ১৯৮১ সালে। অন্যদিকে লুই আই কান নকশা প্রণয়ন করেন ১৯৭৪ সালে। এতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, লুই আই কানের নকশায় জিয়ার মাজার ছিল না।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সৈয়দ আশরাফকে অব্যহতি
২০১৫ সালে একনেক বৈঠকের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতি দেওয়া। এ গুঞ্জন সর্বপ্রথম একনেক বৈঠক থেকেই ছড়িয়ে পড়ে।
৭ জুলাই একনেকের বৈঠকে সৈয়দ আশরাফের অনুপস্থিতিকে ঘিরে শুরু হয় দপ্তর হারানোর গুঞ্জন। তবে গুঞ্জনের অবসান ঘটে এক সপ্তাহের মাথায় দফতরবিহীন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার চূড়ান্ত অনুমোদন
২০১৫ সালের আরও একটি আলোচিত ঘটনা ৩২ লাখ কোটি টাকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক (২০১৫-২০২০) পরিকল্পনার চূড়ান্ত অনুমোদন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনএসি) বৈঠকে ২০ অক্টোবর এ অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তি করে এবারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ৩১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে এক কোটি ২৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
একনেকে অনুমোদন পেল স্বপ্নের টানেলও
বাংলাদেশে এবারই প্রথম চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। এতে করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চলবে যানবাহন। ঢাকা কক্সবাজার যেতে হলে চট্টগ্রাম শহরের যানজটে আটকা পড়তে হবে না। একইভাবে কক্সবাজার থেকে ঢাকা আসতে হলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট এড়িয়ে চলা যাবে।
২০১৫ সালে ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় একনেক সভা। প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে গুঞ্জনের অন্ত ছিল না মন্ত্রণালয়ে। অবশেষে সব অবসান ঘটে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৫
এমআইএস/এএসআর