ঢাকা: বাংলাদেশি নারীদের ‘ঢাকা ডল’ হিসেবে সম্বোধনকে অপমানজনক বলে মনে করছেন শ্রম ও নারী অধিকার বিশেষজ্ঞরা। মালয়েশিয়ার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘দ্য স্টার’ এর অনলাইন ভার্সনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা ডলদের আগমন চিন্তার কারণ হবে না’।
ব্যবসায়িক সংগঠন ওয়ানিতা মালয়েশিয়ান চায়নিজ এসোসিয়েশনের বরাত দিয়ে করা এই রিপোর্টটি ক্ষোভের সঞ্চার করেছে প্রবাসীদের মাঝেও।
মালয়েশিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এই নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। বাংলাদেশি শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় প্রবেশের পরবর্তী প্রেক্ষাপট কি হবে, সেটা নিয়েও চলছে আলোচনা-সমালোচনা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার স্টারে এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশি নারীদের সম্বোধন করা হয়, ‘ঢাকা ডল’ নামে।
প্রতিবেদনটিতে ইউরোপিয়ান প্রেসফটো এজেন্সি’র (ইপিএ) একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের হোলি উৎসবে ৪ নারীর অংশগ্রহণকে দেখানো হয়। অথচ রিপোর্টে বলা হয়েছে বাংলাদেশি নারীরা সেখানে গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাবেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিস (বিলস)-এর সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মেয়েদের ‘ঢাকা ডল’ হিসেবে সম্বোধন করা শুধুমাত্র নারী শ্রমিক নয়, এটা দেশের জন্যেও লজ্জাজনক।
তিনি বলেন, কোন ধরনের সন্মানজনক চুক্তি ছাড়া বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর বিরোধিতা করি। আমাদের দেখতে হবে, ওই দেশের আইনে বিদেশ নারী শ্রমিকের মর্যাদা কতটুকু দেয়া হয়েছে। আমাদের নারীদের যথাযথ সম্মানজনক কাজেই আমাদের বিদেশে পাঠাতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের নারীদের সম্মান রক্ষায় বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। দূতাবাসগুলোতে নারী শ্রমিকদের জন্যে শেল্টার হাউজ থাকতে হবে। যেখানে তারা বিপদে পড়লে এসে আশ্রয় নিতে পারেন। জনশক্তিকে উপযুক্ত করেই আমাদের বিদেশে প্রেরণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শওকত আরা হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মেয়েদের ‘ঢাকা ডল’ হিসেবে সম্বোধন রাষ্ট্রীয় আত্মমর্যাদার জন্যে সম্মানহানিকর। এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। এসব ক্ষেত্রে দেশকেই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে, সেই দেশের দূতাবাসকে প্রতিবাদ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা বিদেশে কাজ করতে যেয়ে হয়রানির শিকারের সংবাদ আমরা শুনতে পাই। আমরা এক্ষেত্রে শ্রীলংকার উদাহরণ গ্রহণ করতে পারি। সৌদিতে এক শ্রীলংকান মেয়েকে যৌন নির্যাতন করতে চাইলে নিজেকে বাচাঁতে আক্রমণকারীদের একজনকে এক পর্যায়ে হত্যা করেন মেয়েটি। তবে শ্রীলংকান সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে মেয়েটিকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয় সৌদি সরকার। আমাদেরকেও নিজেদের আত্মমর্যাদার জায়গা তৈরি করতে হবে। না হলে এ ধরনের ‘ঢাকা ডল’ সম্বোধন শুনতে হবে।
মালয়েশিয়ায় এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ১৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। নারী শ্রমিকসহ আগামী ৩ বছরে এই সংখ্যক শ্রমিক মালয়েশিয়ায় প্রবেশের কথা রয়েছে। মালয়েশিয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রেই চলছে সরকারের এই সিদ্ধান্তের চুলচেরা বিশ্লেষণ।
এখনো জানা যায়নি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নারী শ্রমিকদের কোন সেক্টরে নিয়োগ দেয়া হবে। অনলাইনে মালয়েশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে চলছে কটাক্ষ, রসিকতা। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নারী শ্রমিকদের 'ঢাকা ডল' উল্লেখ করে চলছে রসাত্মক অালোচনা।
কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে রিপোর্ট হয়েছে, বাংলাদেশি পুরুষের প্রতি আকর্ষিত হচ্ছেন মালয়েশিয়ান নারীরা। অনলাইন ফোরামগুলোতে এখন মেয়েদের নিয়ে চলছে ঝড়।
সিউডোনিয়াম ব্ল্যাক হক নামে একজন বলেছেন, বিদেশিদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াটা মালয়েশিয়ানদের জন্যে আর্শ্চযের কিছুই নয়। বিশেষভাবে সুশ্রী কারো প্রতি। কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয় তখনই, যখন পরদেশী মালয়েশিয়া ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে যায়।
ওয়ানিতা মালয়েশিয়ান চায়নিজ এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান হেং সেয়াই একজন নারী হয়েও ব্যবহার করেন অপমানজনক এই শব্দটি। তিনি ওই প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘চায়না ডলদের মতোই বাংলাদেশি নারীদের কাজ করার প্রভাব মালয়েশিয়াতে পড়বে না। ’
তিনি বলেন, ‘যতদূর জানি, বাংলাদেশি নারীরা বেশিরভাগই রেস্টুরেন্টে কাজ করবেন অথবা গৃহকর্মী হিসেবে আসবেন। তাই তাদের জন্য সংসার ভাঙ্গবে এমন সম্ভাবনা আপাতত কমই দেখা যাচ্ছে।
একজন মালয়েশিয়ান নাগরিক তার ফেসবুক পোস্টে এই ধরনের সংবাদের প্রতিবাদ করে বলেছেন, এখানে বাংলাদেশ সর্ম্পকে ধারণা নেই বলেই অনেকে এ ধরনের হাস্যরস ছড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষ কর্মঠ। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ বাঙ্গালি। গত প্রায় ২৬ বছর ধরে সেখানে সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। মেয়েদের শিক্ষার হার শতভাগ।
নামবিহীন আরেকজন অনলাইন ব্যবহারকারী বলেছেন, এ জন্যে বিদেশি শ্রমিকদের দোষারোপ করার কিছু নেই।
তিনি বলেন, তারা একেবারেই সাধাসিধে মানুষ। যারা এখানে কাজ করতে আসেন এবং শেষে এখানেই নিজেদের স্থায়ী করতে চান। সাধারণত তারা কঠোর পরিশ্রমী হন, তাই পরিবারের দায়িত্বও নিতে পারেন ভাল।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
এমএন/আরআই