বরিশাল থেকে: শহরের আকাশ হোটেলে, ইলিশের বড় টুকরো পাতে নিয়ে হতাশ হলেন সফরসঙ্গীদের ক’জন। প্রথমে কড়া ভাজা হয়েছে ইলিশ, এরপর সেগুলোকেই দো-পেঁয়াজা।
দৈনিক ইনকিলাবের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহনাজ পলি আপা খুব মর্মাহত হলেন। যত লোকমা খাবার মুখে তুললেন, ততবারই আক্ষেপ, ‘নাহ! কষ্ট পেলাম। বরিশালের মানুষ ইলিশ ভালো রান্না না করলে মানা যায়? তারা ইলিশের কারখানায় থাকে। ’
আমার কাছে অবশ্য ভালোই লাগলো, হয়তো ক্ষুধা বেশি বলে। পাতলা ডাল, ঘন ডাল, সালাদ, সবজি ভাজি দিয়ে গরম ভাত, এরপর ফালুদা-দইর অপশন। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। কারণ বরিশালে এর আগের দু'বার কাজের চাপে খাওয়া বিষয়টা নেহায়েত গৌন ছিল।
একবার সঙ্গী ছিলেন বর্তমান চিফ অব করেসপন্ডেন্টস সেরাজুল ইসলাম সিরাজ। নির্বাচনের ডামাডোলে দু'জনের ব্যস্ততা ছিল অনেক।
ফল ঘোষণায় প্রায় মাঝরাত, তখন কোনো হোটেল খাবার নিয়ে বসে থাকে? তবু এক হোটেলের পাতিলের তলানি মিললো।
তার আগেরবার বর্তমান চিফ অব ফটো করেসপন্ডেন্টস কাশেম হারুন সঙ্গী। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জনসভা উপলক্ষে শহরে দলের নেতা-কর্মীদের ঢল ছিল। থাকা-খাওয়ায় তাই যুঁত হয়নি।
ফেরি থেকে কাওড়াকান্দির মাটি ছুঁতে আধঘণ্টা লেগে গেল। একটি প্রাইভেট কারের ভুলে জটলা লেগে গিয়ে এমন সময় নষ্ট।
দু’দিকের বোর্ড, দোকানে লেখা নাম পড়তে পড়তে এগোচ্ছিলাম আমরা। ঘাটের পর কিছুদূর এগিয়ে মাদারীপুরের রাজৈর। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের এলাকা- বলছিলেন সফর সঙ্গীরা।
হাইওয়েতে ভ্যানে চড়ে চলছেন সাধারণ মানুষ। রাস্তা বেশ কয়েক কিলোমিটার ছাল ওঠা। গাড়ির ঝাঁকুনি বেশি হচ্ছিল, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এই বুঝি কান-নাক বেয়ে ঘিলু বের হয়ে যায়।
দুইপাশের বাড়িঘর, দোকানপাট ধুলায় ধুসরিত। ভালো রকম বৃষ্টি না হলে আসল চেহারা বের হবে না। জমিতে সবুজ ফসল, সবজির চাষ, চোখে শান্তি দেয়।
মস্তফাপুরে মন্ত্রীর নামে একটি কলেজ দেখলাম। আরেকটু এগোলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর বড় ছবি পাথরে সাজানো।
রাস্তার দু’পাশে পাটকাঠির স্তুপ, সাজানো। কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ে পানের বরজ, পাটকাঠির আড়াল দেওয়া।
বরিশাল বিএম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অশ্বিনী কুমার দত্তের এলাকা দেখালেন বাসস সাংবাদিক তিমির দত্ত দা। বরিশাল বাড়ি তার, তাই গাইডের ভূমিকা নিয়েছেন তিনি।
গৌরনদীর বাটাজোর এসে অটোরিকশার দেখা মেলে। সাধারণ মানুষের বাহন এগুলো। এগিয়ে দু’টি ব্রিজ কাছাকাছি- সুগন্ধা, দোয়ারিকা।
নদী-নালার অঞ্চল বরিশালে ব্রিজ কালভার্ট অনেক। বোঝা যায়, দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল এসব। বরিশাল ঢুকতেও বড় ব্রিজ।
হাতের বামে চোখে পড়ে বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, বিস্তর জায়গা নিয়ে করা; বিকেএসপি রাস্তার পাশে। ঢাকার বাইরে একমাত্র বরিশালে আছে বিকেএসপি- বলেন বাসসে’র সাংবাদিক খায়রুজ্জামান কামাল।
আব্দুর রব সেরনিয়াবাত টিচার ট্রেনিং কলেজও রাস্তার লাগোয়া। আরও এগিয়ে বিএম কলেজ।
শহরে পরিপাটি অশ্বিনী কুমার টাউন হল, বিবিরপুকুর ভালো লাগে। কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে এসে ডানে মোড় নেয় গাড়ি।
খেতে নেমে পড়ি সবাই। খাওয়া শেষে বের হই একটু, আর বুঝতে পারি, পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েও নিজের কর্মফল পাচ্ছেন বরিশালের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ।
বরিশালের মানুষের জন্য তার উন্নয়নকর্ম বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে সে মানুষদের মনে। আসার পথে তার কয়েকটি পোস্টারের ছবি চোখে লেগে আছে।
টুকটাক সুযোগ পেয়ে এক্কেবারে সাধারণ ক'জন মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তারা সম্মান করেন সাবেক এ সংসদ সদস্যকে, যিনি বরিশালের মেয়রও ছিলেন।
বরিশাল সিটির উন্নয়নে তার কাজের, অবদানের অস্বীকার করছেন না কেউই, অকৃতজ্ঞ নন তারা।
বরিশাল সিটি করপোরেশন কভারে যেবার এলাম, জিততে পারেননি শওকত হোসেন হিরণ। এরপর অসুস্থ হলেন, পৃথিবী ছেড়ে গেলেন!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে হিরণকে চেনা মানুষরা কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। তার কট্টর বিরোধীদের সঙ্গে আলাপেও দেখেছি, উন্নয়ন অস্বীকার করেননি কেউ।
শহরের বর্তমান গোছানো সৌন্দর্য, প্রশস্ত রাস্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা বারবার বলছেন মানুষ। ডবল লেনে রাস্তা প্রশস্ত করেছেন তিনি, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করেছেন, আইডব্লিউটি'র দীর্ঘদিনের ভাঙা রাস্তা (পোর্ট রোড) মেরামত করেছেন, যেখানে মাছ এনে রাখা হয়।
বর্তমান নৌ-মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে এসব কাজ করেন বিচক্ষণ হিরণ।
বিএনপি সমর্থিত বর্তমান মেয়রপ্রার্থী আহসান হাবিব কামালের বিজয়ের পর তার সাক্ষাৎকারের সুযোগ হয়েছিল। কথা হয় তার বোন, ভাগ্নীসহ আরও ক'জন আত্মীয়ের সঙ্গে।
তাদের কেউই হিরণের অবদান অস্বীকার করেননি।
বরিশাল শহর থেকে বরগুনার দিকে আসার পথে মনে পড়লো, হিরণের সঙ্গে শেষ দেখার স্মৃতি। পরাজয়ের পরও তার বাড়িতে নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সমাগম দেখেছিলাম।
হিরণ বেঁচে না থেকেও বেঁচে আছেন উপকৃতদের হৃদয়ে। তিনি প্রমাণ করেছেন, কোনো কাজই মরে না, সব কর্মেরই উচিৎ ফল মেলে।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৬
এসকেএস/এমএ