খুলনা থেকে ফিরে: শিশু মারা গেলেও তাকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ভর্তি দেখিয়ে বিল আদায় করা হচ্ছে। লাশ আটকে রেখে অর্থ আদায়, অযথাই আইসিইউতে ভর্তির ঘটনা ঘটছে প্রায়শই।
চারিদিকে চলছে হাসপাতালের দুয়োধ্বনি। স্বাস্থ্য না-কি আর এখন সেবা খাতের মধ্যে পড়ে না। ব্যবসার বড় ক্ষেত্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সে কারণে মুনাফা লুটতে অনেকেই ঢাকঢ়োল পিটিয়ে আসছেন এই খাতে।
ঠিক সেই সময়ে যদি শুনতে পান, কোন রোগীর মৃত্যূর পর জানাজায় হাসপাতালের জন্য দোয়া করা হয়েছে, অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করতে চাইবেন না। ভাববেন পশ্চিমা কোন রাষ্ট্রের কাহিনী বলা হচ্ছে হয়তো। তা কিন্তু নয়। ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশের বিভাগীয় শহর খুলনায় অবস্থিত ফরটিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউটের ক্ষেত্রে।
সুফিয়া খাতুন (৮৫) নামে একজন রোগি হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। একেবারে শেষ মুহূর্তে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টার পর ওই দিনই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। হাসপাতালের সেবা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যায় বৃদ্ধার পরিবার। তার জানাজার নামাজে এএফসি ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউটের জন্য দোয়া কামনা করেন সবার কাছে।
কিভাবে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হল! খোঁজ নিতে গিয়ে নে যা শুনেছি, তাতে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ হাসপাতাল যখন একদিন বেশি ভর্তি দেখিয়ে অর্থ আদায় করেছে, ঠিক তখন কোন রোগি মারা গেলে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার পুরো বিল মওকুফ করে দিচ্ছে ফরটিস। তা যত বেশিই হোক না কেন।
হাসপাতালটি তাদের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে বিনা খরচে মরদেহ পৌছে দিচ্ছে স্বজনদের কাছে। হাসপাতালটির স্টাফ নার্স জুথিকা মণ্ডল বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, আন্যদের কথা বলতে পারি না। আমাদের এমডি সেবার মানসিকতা নিয়েই হাসপাতাল গড়েছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে, সবার আগে জনগণের সেবা। আমি ব্যবসার উদ্দেশ্যে হাসপাতাল করিনি। ব্যবসার মানসিকতা থাকলে প্রথমে ঢাকাকে বেছে নিতাম। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাশ্রয়ী মূলে জনগণের দোর গোড়ায় সেবা পৌছে দেওয়া।
খুলনা অঞ্চলের লোকজন হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করা হতো। কিন্তু পদ্মায় ফেরিতেই লেগে যেতো কয়েক ঘণ্টা। বিলম্বের কারণে পথেই অনেক রোগির জীবনাবসান হয়ে যেতো। আবার অনেক রোগিকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়া হলেও ফেরানো যেতো না। এ জন্যই পদ্মার পশ্চিম পাড়ে এই সেবা চালু করা হয়েছে।
শুধু কি জনগণের কাছে যাওয়া। সেবা ও সার্ভিসের দিক থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে। অনেক হাতপাতাল রয়েছে তারা যা করছেন তার চেয়ে ঢের বেশি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছেন। কিন্তু ফরটিস অনেকটা নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছে।
পদ্মার এপারে (খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে) একমাত্র প্রতিষ্ঠান ফরটিস যারা চব্বিশ ঘণ্টাই প্রাইমারি এনজিও প্লাস্টি করে থাকে। ঢাকাতে চব্বিশ ঘণ্টা এই সার্ভিস পাওয়া যায় শুধু ইউনাইটেড, অ্যাপোলো ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে।
হার্টের রোগের বিশেষায়িত এই হাসপাতালটিতে এতোদিন হার্টের সব ধরনের টেস্ট এবং সব ধরনের অপারেশন পরিচালিত হতো (ওপেন হার্ট সার্জারি ছাড়া)। আগামী মাসে সংযুক্ত হচ্ছে ওপেন হার্ট সার্জারি ইউনিট। এখন আর হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিতে হবে না। খরচও রাজধানীর তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ কম। রাজধানীতে এনজিওগ্রাম করতে ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা লাগে। সেখানে ফরটিস এই টেস্টটি দিচ্ছে মাত্র ১৬ হাজার টাকায়।
খরচ কমের পাশাপাশি উন্নত ও সর্বাধুনিক ডিজিটাল মেশিন সংযোজন করা হয়েছে ফরটিসে। এখানে রয়েছে ইলেক্ট্রনিক আইসিইউ। দু’জন রোগির জন্য একটি করে মনিটর। যার সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ফরটিসের দিল্লির বিশেষজ্ঞরা। দিল্লিতে বসেই রোগির সার্বিক অবস্থা মনিটর করা হয়। সঙ্গে রয়েছে সিসি ক্যামেরা- যার মাধ্যমে কর্তব্যরত ডাক্তার ও নার্সদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে ফরটিস।
হাসপাতালটির আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রত্যেকটি যন্ত্রের মান ও আদ্রতা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনেক বড় বড় হাসপাতাল রয়েছে যেখানে ফার্মেসি হাসপাতালের বাইরে।
কিন্তু ফরটিসের ফার্মেসি হচ্ছে হাসপাতালের অভ্যন্তরে সেন্ট্রাল এসির আওতায়। সারাদিন দরজা খোলা থাকলেও আদ্রতার কমবেশি হওয়ার সুযোগ থাকছে না। যে কারণে এখানে ঔষধের মান থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
ফরটিসের অপারেশন ইন চার্জ সুমিত্র মল্লিক বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি অনেকেই হালকাভাবে নিতে পারেন। কিন্তু ফরটিস খুবই সিরিয়াসভাবে বিষয়টি দেখে থাকে। কারণ আদ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে একটি ঔষধ তার মান হারাতে পারে। আর মান নষ্ট হয়ে গেলে যথাযথভাবে উপকারে আসবে না এটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, আমরা প্রাইমারি এনজিও প্লাস্টির জন্য আমেরিকা থেকে সর্বাধুনিক মেশিন এনেছি। মেশিনগুলো ১৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখতে হয়। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বিষয়টি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে চালু হয়ে যায় জেনারেটর।
ফরটিস একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। শুধু ভারতেই যাদের ৬৬টি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপে তাদের বেশ কিছু শাখা রয়েছে বলে জানা গেছে। ফরটিসের সঙ্গে চুক্তির আওতায় দেশীয় কোম্পানি এএফসি (অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যাল) হেলথ লিমিটেড খুলনার সোনাডাঙ্গায় হাসপাতালটির কার্যক্রম পরিচালিত করছে।
তবে ফরটিস কর্তৃপক্ষ দিল্লি থেকে অনলাইনে মনিটরিং ও ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পাশাপাশি একজন কোয়ালিটি কন্ট্রোলার নিয়োগ দিয়েছেন। যার প্রধান কাজ হচ্ছে হাসপাতালে থেকে সার্বক্ষণিক সেবা ও মান নিয়ন্ত্রণ করা।
হৃদরোগের পাশাপাশি এখানে কিডনির বিভিন্ন পরীক্ষা ও ডায়ালাইসিস করানো হচ্ছে। নতুন করে নিউরোলজি ও নেপ্রোলজি বিভাগ চালু করার প্রক্রিয়া অব্যহত রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও বগুড়ায় ফরটিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ফরটিস সম্প্রতি শতবর্ষী বৃদ্ধার শরীরে সফল এনজিও প্লাস্টি করে চিকিৎসকদের কাছেই বিস্ময় হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।
এএফসি হেলস লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম সাইফুর রহমান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে ইউএসএতে প্রসেস সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করার সময় দেশের জন্য কিছু করতে মনস্থির করেন।
দেশে ফিরে ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য মুন্সীগঞ্জে এএফসি হেলথ লিমিটেড’র ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। কোম্পানিটি সুনামের সঙ্গে কাঁচামাল উৎপাদন করে আসছে। অল্পদিনের ব্যবধানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাকিস্তান, ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দেশের বাজারে ব্যবসা প্রসার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন উন্নত মানের ঔষধ আবিস্কারে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ জন্য তারা ঢাকা ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
এসআই/জেডএম