ময়মনসিংহ: এক আওয়ামী লীগ নেতার বর্বর নির্যাতনের শিকার শিশু সাদ্দামকে ভর্তি করা হয়েছিলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু বৃহস্পতিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার পর হাসপাতালের ৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে হঠাৎ লাপাত্তা হয় ১২ বছর বয়সী শিশুটি।
রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যাওয়া শিশুটির অবস্থান রাত সাড়ে ৯টার দিকে স্পষ্ট হয়। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম জানান, সাদ্দাম ও তার মাকে থানায় ডেকে আনা হয়েছে।
আরও জানান, চুরি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে সাদ্দাম জড়িত কিনা তা জানতেই তাদের ডাকা।
তিনি বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় তিন থেকে চারজনের বিরুদ্ধে সন্ধ্যায় শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেছেন শিশুটির মা। তদন্ত করে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরে থানার ভিতর শিশুটির মা পারভীন আক্তার জোর গলায় বাংলানিউজকে বারবার বলছিলেন, ‘আমার ছেলে ছিনতাই করে না। আমার লগে কাগজ টুকাইয়া (কুড়িয়ে) ভাত খায়। ওরে যারা মারছে অগোর বিচার চাই। ’
নগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সফির উদ্দিন সরুর নির্মম নির্যাতনের শিকার ১২ বছর বয়সী সাদ্দামের মুখেও ছিলো একই উচ্চারণ, ‘আমি চোর, ছিনতাইকারী না। হেরা সন্দেহ কইরা আমারে মারছে। ’
তবে পুলিশের ভাষ্য, নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড় পয়েন্টে চুরি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত সাদ্দাম। বার দু’য়েক এ অভিযোগে আটক হয়েছিলো সে। সবশেষ মাস দু’য়েক আগে তাকে আটকের পর শিশু হওয়ায় ছাড় দেয় পুলিশ।
বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নির্যাতনের কবল থেকে তাকে উদ্ধারের পরও একই বিষয় বিবেচনা করে তাকে শেষ সুযোগ দেয় পুলিশ। তবে সাদ্দাম ও তার মায়ের বক্তব্য ছিল অভিন্ন।
‘আগে এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন বিপথ থেকে ফিরে এসেছে সাদ্দাম। আর নির্যাতনের দিন সাদ্দাম এক নারীর ভ্যানেটিব্যাগ থেকে মোবাইল ছিনতাই করেনি। সন্দেহবশতই তাকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। ’
পারভীন আক্তার ও তার শিশু সন্তান সাদ্দামের মাথা গোঁজার স্থায়ী কোনো আবাস নেই। ইদানীং নগরীর কৃষ্টপুর আদর্শ কলোনিতে তারা থাকেন।
প্রায় পৌনে দু’মাস আগে মারা যান সাদ্দামের বাবা আব্দুল জলিল। মা-ছেলের অন্নের ব্যবস্থা হয় কাগজ কুড়িয়ে।
আওয়ামী লীগ নেতার হাতে নির্যাতনের ঘটনা প্রবাহের সারসংক্ষেপ উঠে আসে মা পারভীন আক্তারের জবানে।
বুধবার খালার কাছ থেকে টাকা আনতে নেত্রকোনার শ্যামগঞ্জ যাচ্ছিলো সাদ্দাম। নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকায় হঠাৎ করেই তাকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে কিল-ঘুষি ও লাঠিপেটা করেন কয়েকজন।
নির্যাতিত শিশুটির মা পারভীন আক্তার বলেন, ‘ওর বাপ নাই। আগে খারাপ ছেলেগর লগে আছিল। দুই মাস আগে অ্যারেস্ট হইছিল এই খারাপ ছেলেগর লগে থাহার কারণে। আমার ছেলে ছিনতাই করে না। টুকাইয়া খায়। ’
নির্যাতন করেছে কেন, প্রশ্ন করতেই পারভীন আক্তারের সাফ জবাব, ‘আমার ছেলে আগে খারাপ ছেলেগর লগে ঘুরতো। তাই সন্দেহ কইরা হেরা অনেক মারছে। লাডি (লাঠি) দিয়া পিডাইছে (পিটিয়েছে)। ওর বুকেও পাড়াইছে। দুই হাত অহনও ফোলা। ’
পাশেই থাকা নির্মম নির্যাতনের শিকার শিশু সাদ্দামও বলতে থাকে, ‘হেগরে কত কইরা কইলাম আমি ছিনতাই করছি না। আমারে মাইরেন না। হেরা তাও আমার বুকে পাড়াইছে। লাডি (লাঠি) দিয়া আমার দুই হাতে অনেক বাইড়াইছে। পুলিশ গিয়া আমারে উদ্ধার করছে। ’
এদিকে, মোবাইল ছিনতাইয়ের অভিযোগে শিশু সাদ্দামকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে।
নগরবাসী শিশু নির্যাতনের এমন পাশবিক ঘটনায় অভিযুক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সফির উদ্দিন সরুসহ ভিডিওচিত্রে ধরা পড়া উসকানিদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
তবে উল্টো পথে হাঁটছেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি খলিলুর রহমান। তিনি নির্যাতনকারী সরুর পক্ষে সাফাই গাইছেন।
বাংলানিউজকে বৃহস্পতিবার রাতে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন এমন, ‘সাদ্দামের মতো ছোট ছোট বাচ্চারা পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকায় চুরি-ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সাদ্দামকে ওইদিন হাতে-নাতে ধরার পর সরু একটু শাসন করেছে। এসব শিশুদের গডফাদারও আছে। ’
এর আগে সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়া প্রায় সাড়ে ৬ মিনিটের ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, নীল চেকশার্ট পরিহিত ওই আওয়ামী লীগ নেতা একটি দোকানঘরে নিয়ে শিশুটির শার্ট চেপে ধরে লাঠি দিয়ে দু’হাতের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে পেটাতে থাকেন।
শিশুটি তার পায়ে ধরে অনেক কাকুতি-মিনতি করলেও পাষণ্ড ওই নেতার মন গলেনি। শিশুটির উপর বর্বর নির্যাতন চালান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৬
এএ/
** এবার ময়মনসিংহে শিশু সাদ্দামকে নির্যাতনের ভিডিওচিত্র